বহুকাল পূর্বে বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীর হতে ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকা পার হয়ে সুসং পাহাড় পর্যন- বিস্তীর্ণ ভূভাগের মধ্যে জয়ানশাহি নামে একটি গহীন অরণ্য অঞ্চল ছিল। এর উত্তরাংশকে বলা হতো মধুুপুরের অরণ্য অঞ্চল এবং দক্ষিণাংশকে বলা হতো ভাওয়ালের অরণ্য অঞ্চল। কেহ কেহ মনে করেন উত্তর দক্ষিণে এই অরণ্য অঞ্চলের দৈর্ঘ্য ছিল পঁয়তাল্লিশ মাইল এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রসে’ ছিল ছয় হতে ষোল মাইল।
দ্বাদশ শতাব্দির পরবর্তী কালে প্রায় ছয়শ বছর পাঠান ও মুঘলরা এদেশ শাসন করে। তাঁদের আমলে এই আরণ্যকের মাঝখানে গড়ে উঠে এক প্রশাসনিক অঞ্চল– যা ভাওয়াল পরগণা নামে পরিচিত। ভাওয়াল পরগণার উত্তরে আটিয়া ও আলেপসিং পরগণা, দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা, পূর্বে লক্ষ্যানদী ও মহেশ্বরদি পরগণা এবং পশ্চিমে কাশিমপুর ও দুর্গাপুর পরগণা। বর্তমান গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও ঢাকা জেলার কতেকাংশে ছিল ভাওয়াল পরগণার অবসস্থান।
অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় ভাওয়াল অঞ্চলের নাম নিয়ে রয়েছে নানা মহলের নানা অভিমত। এসব অভিমতের পেছনে কোন দলিল-দস্তাবেজ, শিলালিপি, প্রাচীন স-ম্ভ, মৃৎলিপি বা গ্রহণযোগ্য কোন প্রামাণক নেই। তবে নামকরণের বিষয়টি প্রচলিত রয়েছে মুখে মুখে, যুগ হতে যুগান-রে। নিচে কয়েকটি অভিমত তুলে ধরা হলো।
১. রাজা ভবপাল বা ভদ্রপালের নাম হতে ভাওয়াল
পাল শাসনামলে এ অঞ্চল পাল রাজ্যভুক্ত ছিল। পাল রাজাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভবপাল বা ভদ্রপাল। এই ভদ্র পালের এক অধঃস-ন পুরুষ শিশুপাল এক সময়ে এ অঞ্চল শাসন করতেন। অনেকে মনে করেন রাজা ভবপাল বা ভদ্রপালের নামানুসারে তার সময়ে এলাকার নাম হয়েছে ভাওয়াল।
২. ভগালয় হতে ভাওয়াল
ভগ+আলয় হতে ভগালয় শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। ভগ অর্থ ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য। এই ছয়টি ভগ বা গুণের যিনি অধিকারী, তিনি ভগবান। আলয় অর্থ নীড়, ঘর, বাড়ি, আশ্রয়স’ল, নিকেতন, ভবন ইত্যাদি। ভগালয় শব্দের অর্থ দাঁড়ায় খ্যাতিমান, যশ্বসী, বিক্রমশালী বা সম্পদশালীর ভবন বা নিকেতন। এই অঞ্চলে সম্পদ বা ঐশ্বর্যের প্রাচুর্য থাকায় ভগালয় হতে ভাওয়াল শব্দের উৎপত্তি বলে অনেকে ধারণা করে থাকেন।
৩. রাজা ভগদত্তের নাম হতে ভাওয়াল
পৌরাণিক তথা মহা ভারতের যুগে ভগদত্ত নামে এক বিক্রমশালী রাজা ছিলেন। তিনি এ এলাকা শাসন করতেন বিধায় তাঁর নামানুসারে ভাওয়াল শব্দটি এসেছে বলে অনেকে মনে করে থাকেন।
৪. আঁতিভোয়াল থেকে ভাওয়াল
অনেকে মনে করেন প্রথম দিকে এই এলাকাকে আঁতিভোয়াল বা আঁতিভোল নামে ডাকা হতো। তারা প্রমাণ স্বরূপ উল্লেখ করেন যে, ভাওয়ালের পূর্ব পাশ দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে আঁতিভোল নামে একটি প্রাচীন নগরী ছিল। আটিয়া ও ভাওয়াল সন্নিহিত দুটি পরগণার নাম আঁতিভোল হতে এসেছে। তাদের ধারণা আঁতিভোয়াল শব্দ থেকে ভাওয়াল নামের উৎপত্তি হয়েছে।
৫. ভাওয়াল গাজীর নাম হতে ভাওয়াল
দিল্লির সম্রাট আকবরের সময়ে যে বারো জন ভূঁইয়া তৎকালীন বাংলায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন তন্মধ্যে অন্যতম ছিলেন পাঠান বংশোদ্ভুত ভাওয়াল গাজী। অনেকে মনে করেন ভাওয়াল গাজী যে এলাকায় স্বাধীন রাজ্য সস্থাপন করেছিলেন তার নামানুসারে নাম হয়েছিল ভাওয়াল পরগণা। জন শ্রুতি রয়েছে ভাওয়াল গাজীর অধঃস-ন এক জমিদার তাঁর পরগণার ৯ আনা হিস্যা জনৈক ব্রাহ্মণ কর্মচারীকে এবং বাকি ৭ আনা হিস্যা দুই জন কায়স’ কর্মচারীকে দান করেন। এরা দিল্লির মুঘল সম্রাট কর্তৃক জমিদার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। ৭ আনা হিস্যার একজন পূবাইলে তাঁর জমিদারি সস্থাপন করেন বিধায় তাকে বলা হতো পূবাইলের জমিদার। অপর জন কাশিমপুরে জমিদারি সস্থাপন করায় তাঁকে বলা হতো কাশিমপুরের জমিদার। অপরদিকে ৯ আনা হিস্যার ব্রাহ্মণ কর্মচারী তাঁর জমিদারি ভাওয়ালে সস্থাপন করায় ভাওয়ালের জমিদার নামে খ্যাত হন।
৬. উপভাষিক শব্দ হতে ভাওয়ালের উৎপত্তি
ভাওয়াল ও মধুপুর অরণ্যাভ্যন-রে রাজবংশী ও হাজং উপজাতির লোকেরা বাস করে। অনেকের মতে তারা ঘন গজারি জাতীয় গাছে আচ্ছাদিত গহীন লাল মাটির টিলা অঞ্চলকে ভাওয়াল বলে অভিহিত করতো। আবার অনেকের মতে পাঠান ও মুঘলরা তাদের শাসিত ছোট ছোট অঞ্চলকে ওজিয়াল বলতো। এই ওজিয়াল থেকে ভাজিয়াল বা ভাওয়াল শব্দটি এসেছে।
ভাওয়াল নামকরণের পিছনে এরূপ আরো বহু মত রয়ে গেছে। উল্লেখযোগ্য মতগুলো ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করলে ভাওয়াল গাজীর নামানুসারে ভাওয়াল পরগণার নামটি সার্থক বলে মনে হয়।
সপ্তদশ শতাব্দির শেষার্ধে জমিদার ভাওয়াল গাজীর অধঃস-ন পুরুষ জমিদার দৌলত গাজীর দেওয়ান বা দিউয়ান হিসেবে কাজ করতেন জনৈক বলরাম। শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন বলরামের পুত্র। জনশ্রুতি রয়েছে শ্রীকৃষ্ণ দান সূত্রে ভাওয়াল পরগণার ৯ আনা হিস্যার অধিকার লাভ করেছিলেন। প্রকৃত পক্ষে শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন অত্যন- চতুর ও কৌশলী। তৎকালীন বাংলার প্রধান দেওয়ান মুর্শিদকুলি খান পরবর্তী কালে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব এর অত্যন- প্রিয় ভাজন হয়ে ওঠেন শ্রীকৃষ্ণ। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে নবাব মুর্শিদকুলি খান বহু মুসলিম জমিদারকে বিতাড়িত করে তদ্স’লে হিন্দু জমিদার নিয়োগ করেছিলেন। ভাওয়ালের জমিদারগণ মুর্শিদকুলি খানের এই নীতির ফলে জমিদারি স্বত্ব হারান। এই সুযোগে শ্রীকৃষ্ণ অত্যন- কৌশলে গাজীদের বঞ্চিত করে জমিদারি হস-গত করেন। এভাবে ১৭০৪ সালে শ্রীকৃষ্ণ ওরফে কৃষ্ণ নারায়ণ নিজেকে ভাওয়ালের জমিদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তখন থেকে ১৯৫১ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন- এই বংশ ক্রমাগতভাবে ভাওয়ালের জমিদারি স্বত্ব ভোগ করেন। ভাওয়াল জমিদার পরবর্তীতে ভাওয়াল রাজ পরিবারের সদস্যগণ নিজেদেরকে বিক্রমপুরের বিখ্যাত বজ্রযোগিনী গ্রামের পুশিলাল শোত্রীয় ব্রাহ্মণগোত্র ভুক্ত বলে দাবি করতেন। প্রসংগতঃ বজ্রোযোগিনী গ্রামেই প্রায় হাজার বছর আগে বিখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিত ও বিশ্বপরিব্রাজক অতিশ দীপাঙ্কর জন্ম গ্রহণ করেছিলেন।
১৭৯৩ সালে লর্ড কর্ণওয়ালিশ চিরসস্থায়ী বন্দোবস- আইন প্রবর্তন করেন। চিরসস্থায়ী বন্দোবস- আইন প্রবর্তনের পর ভাওয়াল জমিদার অনেক ছোট খাট জমিদারি ও জমি ক্রয় করে একটি বড় জমিদারির মালিক হন। ১৮৫১ সালে পরিবারটি নীলকর জেমস ওয়াইজের জমিদারি ক্রয় করে সম্পূর্ণ ভাওয়াল পরগণার মালিক হয়ে যান। সরকারি রাজস্ব নথিপত্র হতে জানা যায় যে, ভাওয়ালের জমিদার ৪,৪৬,০০০/- টাকা দিয়ে ওয়াইজের জমিদারি ক্রয় করেছিলেন, যা ছিল সে যুগের মূল্যমানের বিচারে একটি বড় ধরণের অংক।
শ্রীকৃষ্ণ ওরফে কৃষ্ণ নারয়ণের মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র জয়দেব নারায়ণ জমিদারি লাভ করেন। জয়দেব নারায়ণের নামানুসারে পীরবাড়ি মৌজার নাম বদলিয়ে রাখা হয় জয়দেবপুর। জয়দেব নারায়ণের মৃত্যুর পর ইন্দ্র নারায়ণ এবং তৎপুত্র কীর্তি নারায়ণ জমিদার হন। কীর্তি নারায়ণের পর তৎপুত্র লোক নারায়ণ এবং তাঁর মৃত্যুর পর তৎপুত্র গোলক নারায়ণ জমিদারি লাভ করেন। গোলক নারায়ণের মৃত্যুর পর তৎপুত্র কালি নারায়ণ জমিদার হন। ব্রিটিস শাসকদের প্রতি আনুগত্য পোষণ ও যোগ্যতার জন্য তিনি খ্যাতি লাভ করেন। ১৮৭৮ সালে ঢাকার নর্থব্রুক হলে তৎকালীন ভারতের বড়লাট লর্ড লিটনকে তিনি এক জাঁকজমক পূর্ণ সংবর্ধনা দেন। বড়লাট কালি নারায়ণের প্রভু ভক্তিতে গদগদ হয়ে তাকে রাজা উপাধিতে ভূষিত করেন। তখন তিনি পরিচিতি লাভ করেন ভাওয়ালের রাজা কালি নারায়ণ রায় চৌধুরী হিসেবে। সেই থেকে ভাওয়াল জমিদার পরিবার ভাওয়াল রাজ পরিবারের মর্যাদা লাভ করে।
রাজা কালি নারায়ণ রায় চৌধুরীর তিন স্ত্রীর মধ্যে ছোট স্ত্রীর নাম ছিল রাণী সত্যভামা দেবী। অপর দুই স্ত্রী ছিলেন রাণী যামিনী দেবী এবং রাণী ব্রক্ষ্মময়ী দেবী। এই দুই রাণী নিঃসন্তান ছিলেন। রাণী সত্যভামা দেবীর গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী এবং কন্যা কৃপাময়ী দেবী। পিতার মৃত্যুর পর রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী ভাওয়ালের রাজা হন। তিনি বিয়ে করেছিলেন বরিশাল জেলার বানারিপাড়ার বিলাসমণি দেবীকে। রাজা রাজেন্দ্র রায় চৌধুরী পিতার ন্যায় যোগ্য ও কৌশলী ছিলেন। তিনি জমিদারির আরো বিস্তৃতি ঘটান। এই সময়ে ভাওয়াল জমিদারি ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও বাকেরগঞ্জ জেলায় বিস্তৃত হয়ে পড়ে এবং পূর্ব বঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমিদারিতে পরিণত হয়।
রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর স্ত্রী রাণী বিলাসমণি দেবীর গর্ভে তিন পুত্র ও তিন কন্যা জন্ম গ্রহণ করেন। প্রথম সন্তান কন্যা ইন্দুময়ী দেবীর বিয়ে হয়েছিল গোবিন্দচন্দ্র মুখোপধ্যায় এম এ বি এল এর সাথে। দ্বিতীয় সন্তান কন্যা জ্যোতির্ময়ী দেবীর বিয়ে হয়েছিল জগদীশ চন্দ্র মুখোপধ্যায়ের সঙ্গে। তৃতীয় সন্তান পুত্র বড়কুমার রণেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী বিয়ে করেছিলেন সরযূবালা দেবীকে। তিন কুমারের মধ্যে রণেন্দ্র নারায়ণ কিছুটা লেখা পড়া শিখেছিলেন। ফলে ব্রিটিস রাজ পুরুষদের সাথে তিনি যোগাযোগ রক্ষা ও আলাপচারিতা করতে পারতেন। চতুর্থ সন্তান পুত্র কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী কোনরূপ নাম সহি করতে পারতেন। তিনি ছিলেন অমিতাচারী। খেলাধুলা আর শিকারের প্রতি তাঁর প্রবল ঝোঁক ছিল। তিনি ১৯০২ সালের মে মাসে হুগলীর বিষ্ণুপদ মুখার্জির মধ্যমা কন্যা বিভাবতীকে বিয়ে করেন। রমেন্দ্র নারায়ণ মেজোকুমার নামে পরিচিত ছিলেন। পঞ্চম সন্তান পুত্র কুমার রবীন্দ্র নারায়ণ রায়ের সাথে বিয়ে হয়েছিল আনন্দ কুমারী দেবীর। ষষ্ঠ সন্তান কন্যা তড়িন্ময়ী দেবীর বিয়ে হয়েছিল বাবু ব্রজলাল ব্যানার্জী এম এ বি এল এর সাথে।
রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী ১৯০১ সালের ২৬ এপ্রিল মৃত্যু বরণ করেন। হিন্দু আইনানুসারে তাঁর মৃত্যুর পর ভাওয়াল রাজ্য বা এস্টেটের মালিক হন তিন পুত্র। কিন্তু কুমারগণ নাবালক থাকায় তাঁদের মা রাণী বিলাসমণি দেবী ট্রাস্টি হিসেবে এস্টেট পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন। আর এ কারণে ভাওয়াল রাজ এস্টেট এক সময়ে রাণী বিলাসমণি এস্টেট নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। ১৯০৭ সালের জানুয়ারি মাসে রাণী বিলাসমণি মৃত্যু বরণ করেন। অতঃপর তিন কুমার সমান হিস্যায় ভাওয়াল এস্টেটের মালিকানা প্রাপ্ত হন। কিন’ ১৯০৯ সালে মেজোকুমার রামেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর কথিত মৃত্যুর পর এস্টেটের এক তৃতীয় অংশের মালিকানা চলে যায় তাঁর কথিত বিধবা স্ত্রী বিভাবতী দেবীর হাতে। বিভাবতী তাঁর ভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথ এর হাতে এস্টেটের এক তৃতীয়াংশের ভার ছেড়ে দিয়ে কোলকাতায় গিয়ে বিধবা বেশে জীবন যাপন করতে থাকেন। বড় কুমার রণেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি ১৯১২ সালে এবং ছোট কুমার রবীন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি ১৯১৩ সালে উভয়ে নিঃসন্তান অবসস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। অবশ্য ছোট কুমারের স্ত্রী আনন্দ কুমারী দেবী পরবর্তীকালে কুমার রাম নারায়ণ রায় চৌধুরিকে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ভাওয়াল রাজ বংশের তিন কুমারের মৃত্যুর পর ১৯১৩ সালে ব্রিটিস সরকার ভাওয়াল রাজ এস্টেট পরিচালনার ভার কোর্ট অব ওয়ার্ডস অ্যাক্ট ১৮৭৯ (ইবহমধষ অপঃ ওঢ ড়ভ ১৮৭৯) এর ৬ ধারার ক্ষমতা বলে গ্রহণ করেন। ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন বলে ১৯৫১ সালে জমিদারি প্রথার বিলোপ ঘটলেও আইনগত জটিলতার কারণে ভাওয়াল এস্টেটের কিছু কিছু সম্পত্তি এখনও কোর্ট অব ওয়ার্ডস ভাওয়াল রাজ এস্টেট নামে বাংলাদেশ সরকার ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন ভূমি সংস্কার বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালনা করছেন। কোর্ট অব ওয়ার্ডস ভাওয়াল রাজ এস্টেট সম্পর্কে বিস-রিত আলোচনার পূর্বে কোর্ট অব ওয়ার্ডস আইন ১৮৭৯ এবং ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলার উপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।
“ভাওয়াল রাজ বংশ” অধ্যায়ে ভাওয়াল রাজ বংশের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হয়েছে। দিল্লির সম্রাট আকবরের সময়ে তৎকালীন বাংলায় যে বারো জন ভূঁইয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, তন্মধ্যে ভাওয়াল গাজী ছিলেন অন্যতম। অনেকে মনে করেন ভাওয়াল গাজী যে এলাকায় স্বাধীন রাজ্য সস্থাপন করেছিলেন, তাঁর নামানুসারে ঐ এলাকার নাম হয়েছিল ভাওয়াল পরগণা। ভাওয়াল গাজীর অধঃস-ন পুর”ষ দৌলত গাজীর দিউয়ান হিসেবে জনৈক বলরাম রায় কাজ করতেন। বলরাম রায়ের বংশধরেরা নিজেদেরকে বিক্রমপুরের বিখ্যাত বজ্রযোগিনী গ্রামের পুশিলাল শোত্রীয় ব্রাহ্মণ গোত্রভুক্ত বলে দাবি করতেন। জনশ্র”তি রয়েছে বলরামের পুত্র শ্রীকৃষ্ণ ওরফে কৃষ্ণ নারায়ণ রায় দানসূত্রে ভাওয়াল পরগণার নয় আনা হিস্যার অধিকার লাভ করে জমিদার শ্রেণীভুক্ত হয়েছিলেন। কিন’ ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ে সুবে বাংলার সুবাদার হিসেবে নিযুক্তি পেয়েছিলেন সম্রাটের পৌত্র আজিম-উস্শান বা আজিমুদ্দিন। তিনি একাধারে প্রশাসন বিভাগের প্রধান হিসেবে সুবাদার এবং রাজস্ব বিভাগের প্রধান হিসেবে দিউয়ানের দায়িত্ব পালন করতেন। আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতির ফলে তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন মারাঠা দমনে। যুদ্ধ বিগ্রহের ব্যয় নির্বাহের জন্য বাংলার রাজস্বের উপর তিনি ছিলেন অনেকাংশে নির্ভরশীল। আজিম-উস-শান ভবিষ্যতে দিল্লির মসনদে আরোহনের কথা ভেবে প্রজাপ্রীড়ন এবং ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে অর্থ সম্পদ সঞ্চয়ে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন। বাংলা থেকে প্রয়োজনীয় রাজস্ব প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য সম্রাট বাংলার দিউয়ান হিসেবে নিয়োগ দেন মুর্শিদ কুলি খানকে। ইতোপূর্বে মুর্শিদকুলি খান বিহার ও উড়িষ্যার দিউয়ান হিসেবে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। তাকে অতিরিক্ত সুবে বাংলার দিউয়ানেরও দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তিনি ঢাকায় এসে আজিম-উস-শানের অতিরিক্ত অর্থ আদায় বন্ধ করে দিলেন। শাহাজাদা মুর্শিদ কুলি খানকে ভাল চোখে দেখলেন না। তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করলেন। এ পরিকল্পনা তিনি ব্যর্থ করে দিয়ে সম্রাটের অনুমতিক্রমে ঢাকা হতে রাজধানী ভাগিরথীর তীরে মখসুদাবাদে সস্থানান-রিত করলেন। অতঃপর বাংলার বকেয়া রাজস্ব আদায়ে মনোযোগী হলেন। মুর্শিদকুলি খানের নামানুসারে মখসুদাবাদের নাম হয় মুর্শিদাবাদ। তিনি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব হিসেবে পরিগণিত হন। নবাব মুর্শিদকুলি খান বাংলায় ”তৃতীয় মুঘল” বন্দোবস- চালু করেন। তিনি সুবা-ই-বাংলাকে ১৩টি চাকলা এবং ১৬৬০ টি পরগণায় বিভক্ত করে শাহসুজার আমলে ধার্যকৃত রাজস্ব ১,৩১,১৫,৯০৭/- টাকার স’লে ১,৪২,৮৮,১৫৬/- টাকা ধার্য করেন। এ সময় রাজস্ব বৃদ্ধির পরিমাণ দাঁড়ায় ১১,৭২,২৭৯/- টাকা। মুর্শিদকুলি খান অধিক রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে নতুন করে ভূমির বন্দোবস- দিয়ে জমিদার শ্রেণীর সৃষ্টি করেন। এ সময় হতে প্রকৃত ভূমি মালিকগণ তাদের মালিকানা স্বত্ব হারাতে থাকে। রাজস্ব বকেয়ার দায়ে পুরাতন জমিদারদের উ”েছদ করে নব্য জমিদারেরা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মুর্শিদ কুলি খানের অন্যতম রাজস্ব নীতি ছিল মুসলিম প্রজা সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় হিন্দু জমিদার নিয়োগ। তাঁর সময়ে অসংখ্য মুসলিম জমিদার বিতাড়িত হন এবং তদস’লে হিন্দু জমিদারগণ জমিদারি লাভ করেন। সম্ভবতঃ শ্রীকৃষ্ণ দানসূত্রে নয় বরং মুর্শিদকুলি খানের উক্তরূপ রাজস্ব নীতির কারণে ১৭০৪ সালে ভাওয়াল জমিদার দৌলত গাজীর জামিদারির বৃহদাংশ লাভ করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ ওরফে কৃষ্ণ নারায়ণ রায়-ই হলেন ভাওয়াল জমিদার বংশের আদি প্রতিষ্ঠাতা।
কৃষ্ণ নারায়ণের মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র জয়দেব নারায়ণ ভাওয়ালের জমিদারি লাভ করেন। জয়দেব নারায়ণের নামানুসারে পীরবাড়ি মৌজার নামকরণ হয় জয়দেবপুর। জয়দেব নারায়ণের মৃত্যুর পর তার পুত্র ইন্দ্র নারায়ণ এবং ইন্দ্রনারায়ণের লোকান-রে তৎপুত্র কীর্তি নারায়ণ ভাওয়ালের জমিাদারি প্রাপ্ত হন। কীর্তি নারায়ণের মৃত্যুর পর তৎপুত্র লোকনারায়ণ এবং তার মৃত্যুর পর তৎপুত্র গোলক নারায়ণ জমিদারি লাভ কর্রেছিলেন। গোলক নারায়ণ ইহধাম ত্যাগ করলে তার পুত্র কালি নারায়ণ রায় ভাওয়ালের জামিদার হন।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির আমবাগানের প্রহসনমূলক যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতন ঘটে। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬৫ সালের ১২ আগস্ট মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমকে বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা রাজস্ব প্রদানের বিনিময়ে বাংলা বিহার উড়িষ্যার দেওয়ানি বা দিউয়ানি লাভ করে। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে ১৭৭২ সালে পাঁচসনা বা পাঁচ সালা, ১৭৭৭ সালে এক সনা বা বাৎসরিক এবং ১৭৯০ সালে দশ সনা বা দশ সালা বন্দোবসে-র ব্যবসস্থা করে। দশসনা বন্দোবসে-র আগে তালুকদারগণ জমিদারগণের মাধ্যমে খাজনা বা রাজস্ব পরিশোধ করতো। দশ সনা নীতির ফলে তালুকদারগণ সরাসরি কোম্পানির নিকট খাজনা পরিশোধের সুযোগ লাভ করে। ফলে কোম্পানি লাভবান হলেও জমিদারগণ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস’ হয়। জমিদারগণ এই বন্দোবস- প্রক্রিয়া মেনে নিতে পারেনি।
আলেকজেণ্ডার ডাও তাঁর ’হিষ্টি অব হিন্দুস্তান (১৭৭২)’ এবং হেনরি পান্ডলো তাঁর ”এ্যান এসে অন দি কাল্টিভেশন অব দি ল্যান্ডস ইমপ্র”ভমেন্ট অব দি রেভিনিউস অব বেঙ্গল (১৭৭২)” গ্রনে’ ভূমি রাজস্ব ব্যবসস্থাকে চিরসস্থায়ী বন্দোবস- চালু করার পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন। ডাও মনে করেছিলেন, ভূমি রাজস্ব চিরসস্থায়ী বন্দোবস- হলে কৃষির উন্নতি ঘটবে, আর কৃষির উন্নতি ঘটলে বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে। অপর দিকে হেনরি পান্ডলো প্রাকৃতিক সম্পদকে আয়ের প্রধান উৎস বিবেচনা করে ভূমি রাজস্বের জন্য চিরসস্থায়ী বন্দোবস- প্রবর্তনের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। ইংল্যাণ্ডের রাজনৈতিক মহলে চিরসস্থায়ী বন্দোবসে-র স্বপক্ষে অনুকূল মনভাব ও তৎকালীন গভর্ণর জেনারেল লর্ড কর্ণওয়ালিশের জোর সুপারিশে ইংল্যাণ্ডের প্রধান মন্ত্রী পিট এবং বোর্ড অব কন্ট্রোলের প্রেসিডেন্ট হেনরি ডান্সাস ভারত বিষয়ে অভিজ্ঞ চার্লস গ্রাট এবং জন শোরের সংগে আলোচনা করে ১৭৯২ সালের ২৯ আগস্ট ডিরেক্টর সভায় চিরসস্থায়ী বন্দোবস- প্রদানের জন্য গভর্ণর জেনারেল লর্ড কর্ণওয়ালিশকে নির্দেশ দেন। লর্ড কর্ণওয়ালিশ ১৭৯৩ সালের ২২ মার্চ চিরসস্থায়ী বন্দোবসে-র ঘোষণা দেন। এই বন্দোবসে-র ফলে জমিদার ও স্বাধীন তালুকদারগণ নির্ধারিত রাজস্ব নিয়মিত পরিশোধের বিনিময়ে উত্তরাধিকার সূত্রে জমিদারি ভোগের সুযোগ পেলেন। এই আইনে ভবিষ্যতে খরা বা দুর্যোগের কারণে রাজস্ব মওকুফ রহিত করা হয়। প্রতি বছর ৩০ চৈত্র সূর্যাসে-র পূর্বে নির্ধারিত খাজনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে পুরো জমিদারি অথবা অংশ বিশেষ বিক্রি করে সরকারি পাওনা পরিশোধের ব্যবসস্থা রাখা হয়। জমিদারগণকে পুলিশি ও ম্যাজিস্ট্রেসি দায়িত্ব পালন হতে বিরত করা হয়। এই আইনে জমিদারগণকে জমিদারি বিক্রয়, বন্ধক, দান বা অন্য কোন ভাবে হস্তান-রের ক্ষমতা প্রদান করা হয়।
চিরসস্থায়ী বন্দোবসে-র পরবর্তী সময়ে ভওয়াল জমিদার পরিবার আশে পাশের বহু ছোট-খাট জমিদারি এবং জমি ক্রয় করে একটি বড় জমিদারির মালিক হয়। ১৮৫১ সালে ভাওয়াল পরিবার নীলকর জেমস্ ওয়াইজের জমিদারি ক্রয় করেন। ফলে ভাওয়াল পরগণার সম্পূর্ণটাই ভাওয়াল জমিদারির অধীনে আসে। সরকারি রাজস্ব নথিপত্র হতে জানা যায় যে, ভাওয়াল জমিদার ৪,৪৬,০০০/- টাকার বিনিময়ে নীলকর ওয়াইজের জমিদারি ক্রয় করেছিলেন, যা ছিল সেই যুগের মূল্যমান বিচারে একটি বিশাল অংক। ১৮৭৮ সালের এই পরিবারের জমিদার কালি নারায়ণ রায় ঢাকার নর্থ ব্র”ক হলে ভারতের বড়লাটকে এক জমকাল বিশাল সংবর্ধনা প্রদান করেন। বড়লাট লর্ড লিটন এই বিশাল জমকাল সংবর্ধনায় অবিভূত হন। জমিদার কালি নারায়ণ রায়ের প্রভুভক্তিতে হন মুগ্ধ। বড়লাট জামিদার কালি নারায়ণ রায়কে ’রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং বংশ পরম্পরায় রাজা উপাধি ব্যবহারের অনুমতি দেন। সেই থেকে জমিদার কালি নারায়ণ রায় হলেন রাজা কালি নারায়ণ রায় চৌধুরী এবং ভাওয়াল জমিদার পরিবারটি পরিণত হলো ভাওয়াল রাজ পরিবার। কালি নারায়ণ রায় চৌধুরী ছিলেন একজন চৌকস জমিদার। তাঁর বুদ্ধিমত্তা, ইংরেজদের প্রতি আনুগত্য পোষণ, সর্বোপরি প্রজাদের সুযোগ সুবিধার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি জমিদারি প্রসারে এবং পরিচালনায় অত্যন- ফলপ্রসূ হয়েছিল। বাংলদেশের অধিকাংশ জমিদার তাঁর জমিদারি এলাকায় বসবাস করতেন না। বেশির ভাগ জমিদার অনংবহঃু খধহফ খড়ৎফ হিসেবে বাইরে থেকে নায়েব, গোমস্তা, পিয়াদা-পাইক এর মাধ্যমে খাজনা আদায় করতেন। আর জমিদারগণ করতেন কোলকাতা কেন্দ্রিক বিলাসী জীবন যাপন। এক্ষেত্রে ভাওয়াল জমিদার পরিবার ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী।
ভাওয়াল জমিদার পরিবার জমিদারির একেবারে কেন্দ্রে অবসি’ত জয়দেবপুর গ্রামে বাস করতেন। তাঁদের বাড়িটি রাজ বাড়ি নামে পরিচিত। বর্তমানে উক্ত রাজ বাড়িতে গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সস্থাপিত হয়েছে।
জয়দেবপুরের রাজবাড়িটি ছিল রেল লাইনের পূর্ব পাশে। রাজবাড়ির সামনের দিকের রাস্তাটির নাম ছিল রাজবাড়ি রোড। রাজপরিবারের কোন লোকের মৃত্যু হলে তার মৃতদেহ দাহ করা হত চিলাই নদীর পাশে, নির্দিষ্ট শ্মশানে। চিলাই নদীতে স্নানের জন্য রাজ পরিবারের লোকজন ব্যবহার করতেন একটি নির্দিষ্ট স্নানের ঘাট। এই স্নানের ঘাটটির নাম ছিল ’শিকদার’ ঘাট।
রাজবাড়িতে প্রবেশ করতে গেলে প্রথমেই পড়ত বড় দালান। এই দালানে অবশ্য রাজপরিবারের কোন লোকজন বসবাস করতেন না। বড় দালানে থাকতেন রাজবাড়ির অতিথিরা। রাজবাড়ির অতিথি হয়ে যারা জঙ্গলে শিকার করতে আসতেন তাঁরা এই বড় দালানে উঠতেন। তাঁদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবসস্থা ছিল এই বড় দালানে। অবশ্য কিছু পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল ১৯০২ সালের পর থেকে।
এই সময় মিঃ মেয়্যার রাজ এস্টেটের ম্যানেজার নিযুক্ত হয়ে জয়দেবপুর রাজবাড়িতে এসে উঠেছিলেন। তিনি বড় দালানটিকে তাঁর নিজের বাসসস্থান হিসেবে ব্যবহার করতে শুর” করেছিলেন। বড় দালানের পিছনেই ছিল ’নাটমন্দির’। এই নাটমন্দিরের দু পাশেই ছিল ঝুল বারান্দা। এই ঝুল বারান্দা ছিল নাটমন্দির ঘিরে দু-পাশের দালানে। এই দোতালা বাড়ির ঝুল বারান্দা থেকে রাজপরিবারের মহিলারা নাটমন্দিরে অনুষ্ঠিত যাত্রা, থিয়েটার প্রভৃতি অনুষ্ঠানগুলি দেখতেন। গান-বাজনা হলে এখানে বসেই তাঁরা সেই সব শুনতেন। বাড়ির একটি ঘরকে ব্যবহার করা হত ঠাকুরঘর হিসেবে। ঠাকুরঘরটিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল জগদ্ধাত্রীর মূর্তি (বিগ্রহ)। জগদ্ধাত্রী পূজা উপলক্ষে প্রতি বছর নাটমন্দিরে গান-বাজনার আসর বসতো। এছাড়াও প্রতি বছর নাটমন্দিরে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হতো। একাধিক উৎসব পালন করা হতো জয়দেবপুর রাজবাড়িতে। ভাওয়াল এস্টেটের প্রজারা রাজবাড়ির উৎসবগুলিতে যোগদান করতেন। উত্তর দিকের বাড়ির দোতলার একটি ঘর ছিল রাজবাড়ির সদর বৈঠকখানা।
এই বাড়ির পিছনের দিকে ছিল রাজবাড়ির অন্দরমহল। অন্দরমহলটিকে বলা হতো পুরানো বাড়ি। পুরানো বাড়ির পশ্চিমদিকের অংশটিকে বলা হতো পশ্চিমাখণ্ড। রাজবাড়ির পিছনের দিকে খোলা অংশে ছিল একটি বাগান। পূর্বদিকে চিলাই নদী। পশ্চিমদিকে ছিল একটি বড় দীঘি। রাজবাড়ির মেয়েরা মাধব বাড়ির পাশ দিয়ে পশ্চিমের দীঘিটিতে যাতায়াত করতেন।
’মাধব বাড়িতে’ ছিল ’রাধামাধবের’ মূর্তি। ’রাধা মাধবের’ মূর্তিটি ছিল পাথরের। মাধব বাড়ির পিছনে ছিল রাজবিলাস। রাজা কালি নারায়ণের মৃত্যুর পর রাজপরিবারের লোকজন সাধারণত বাস করতেন রাজাবিলাসে। জয়দেবপুর বাজবাড়িতে ছিল ডাক্তারখানা, খাজাঞ্চিখানা, ফরাসখানা, বাবুর্চিখানা প্রভৃতি। রাজবাড়ির ইউরোপিয়ান অতিথিদের জন্য ছিল একজন অহিন্দু পাচক। এ ছাড়া বাইরের দালানে ছিল ছবিঘর।
রাজবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই ছিল পোলো খেলার ময়দান। ১৯২১ সালের ১৫ই মে যখন বিতর্কিত সন্ন্যাসীটি জয়দেবপুরে এসেছিলেন, তখন এই পোলো ময়দানেই একটি বিরাট সভার আয়োজন করা হয়েছিল সন্ন্যাসীর নিজের মুখে তার বক্তব্য শোনার জন্য। তাঁকে দেখার জন্য বহু মানুষের সমাগম হয়েছিল রাজবাড়ির এই পোলো খেলার ময়দানে।
এছাড়াও রাজবাড়িতে ছিল ’দেওয়ান খানা’। রাজবাড়ির কাছেই ছিল এম-ভি স্কুল। পরে অবশ্য স্কুলটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছিল ’রাণী বিলাসমণি স্কুল’। স্কুলটির বোর্ডিং হাউসটি ছিল স্কুলবাড়ির দক্ষিণদিকে। রাজবাড়ির সন্নিকটে রেল লাইনের পাশে প্রতি সপ্তাহের সোমবার এবং শুক্রবার হাট বসতো। রাজবাড়ির চত্বরে ছিল ঘোড়াশালা এবং হাতিশালা। পিলখানার পাশাপশি ছিল মাহুতদের থাকার বাসসস্থান।
মেজোকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ যখন ১৯০৯ সালে দার্জিলিং ভ্রমণে গিয়েছিলেন, সেই সময় রাজবাড়ির হাতিশালে ছিল ১৩টি হাতি। প্রত্যেকটি হাতির ছিল আলাদা আলাদা নাম।
ঢাকার বুড়িগঙ্গার পাশে নলগোলায় ভাওয়ালরাজের একটি বাড়ি ছিল। কুমারেরা ঢাকায় এলে নলগোলার বাড়িটিতে উঠতেন। রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণের মৃত্যুর পর কুমাররা খুব ঘন ঘন ঢাকার নলগোলার বাড়িতে যাতায়াত করতেন। ভাওয়াল রাজের ’মতিয়া’ নামে একটি লঞ্চ ছিল। বুড়িগঙ্গায় বাঁধা থাকতো লঞ্চটি। ঢাকায় এলে কুমাররা এই ’মতিয়া’ নামক লঞ্চে করে ঘুরে ফিরে বেড়াতেন। এ ছাড়াও ভাওয়ালরাজের ছিল একাধিক নৌকা।
রাজা কালি নারায়ণ রায় চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার পুত্র রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী ভাওয়াল জামিদারির মালিকানা প্রাপ্ত হন। রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী হিন্দু শাস্ত্র্ত্র মতে বিয়ে করেছিলেন বরিশাল জেলার বাণারিপাড়ার চতুর্দশ বর্ষীয়া নাবালিকা বিলাস মণি দেবীকে। রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী পিতার ন্যায় চৌকস এবং করিৎকর্মা ছিলেন। তিনি ভাওয়াল জমিদারির আরো বিস্তৃতি ঘটান। তাঁর সময়ে ভাওয়াল জমিদারি ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও বাকেরগঞ্জ জেলায় বিস্তৃত হয়ে পড়ে এবং পূর্ব বাংলার দ্বিতীয় বৃহৎ জমিদারিতে পরিণত হয়। প্রসংগক্রমে উল্লেখ্য যে, এ সময়ে পূর্ব বাংলার সর্ববৃহৎ জমিদারি ঢাকা নবাব এস্টেটটি বিভিন্ন জেলায় বিস্তার লাভ করেছিল এবং জমিদারির প্রশাসনিক কেন্দ্র ঢাকা শহরেই অবসি’ত ছিল। প্রধানতঃ আহসান মঞ্জিল হতে ঢাকা নবাব এস্টেট হতে পরিচালিত হতো। কিন’ ঢাকা শহরের অংশ বিশেষ এবং আশে পাশের প্রায় সকল জমির মালিক ছিলেন ভাওয়াল রাজা।
১৯১৭ সালের ভূমি জরিপ ও বন্দোবস- রেকর্ডে দেখা যায় যে, ভাওয়াল রাজ পরিবারটি বিভিন্ন সস্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ২২৭৪টি মৌজায় ৪,৫৯,১৬৩.৩০ একর জমির মালিক হয়েছিলেন। ভাওয়াল রাজ এস্টেটের প্রদত্ত হিসেব থেকে দেখা যায় ১৯০৪ সালে ভাওয়াল রাজের জমিদারির ভূমি রাজস্ব বাবদ সরকারকে প্রদান করা হয়েছিল ৮৩,০৫২/- টাকা এবং সকল খরচ-খরচা বাদে নিট আয় হয়েছিল ৪,৬২,০৯৬/- টাকা।
ভাওয়াল এস্টেটের জমিদারির ব্যবসস্থাপনা ছিল সুদৃঢ় এবং দক্ষতাপূর্ণ। রাজা নিজেই জমিদারি পরিচালনা করতেন। সনাতনীভাবে বেশিরভাগ বড় জমিদার তাঁদের জমিদারি ব্যবসস্থাপনার জন্য নির্ভর করতেন নায়েব, গোমস্তা, পিয়াদা, পাইকের উপর। কিন’ ভাওয়াল রাজ স্বহসে- জমিদারি পরিচালনা করতেন এবং প্রতিদিন নির্ধারিত সময়ে জমিদারি সেরেস্তায় বসতেন। সম্পূর্ণ জমিদারিটি ভাওয়াল রাজ কয়েকটি সার্কেলে বিভক্ত করেছিলেন। প্রতিটি সার্কেল একজন মফস্বল নায়েবের উপর ন্যস- ছিল, যাকে একজন তহশিলদার, মুহুরি, জমাদার, পিওন, ঝাড়-দার এবং কুলি সাহায্য করতো। এ ছাড়াও তার অধীনে থাকতো একদল লাঠিয়াল, যাদেরকে প্রয়োজনে অবাধ্য রায়ত বা প্রজাদের অনুগত করার কাজে ব্যবহার করা হতো। প্রতিটি গ্রামে একজন মণ্ডল থাকতো, যার মাধ্যমে খাজনা আদায় করা হতো। জমির খাজনা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে মাঝেমাঝে প্রত্যেকটি গ্রাম জরিপের ব্যবসস্থা ছিল। বাংলার অন্যান্য জমিদারের মত ভাওয়াল রাজ সাধারণভাবে কোন মধ্যস্বত্বভোগী রায়ত সৃষ্টি করেননি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সি.এস রেকর্ডে দেখা যায় উপরিস্বত্ব ভাওয়াল রাজের এবং নিম্নস্বত্ব সরাসরি রায়তের বা ভূমি মালিকের। ভাওয়াল জমিদারির প্রধান কাচারি ছিল জয়দেবপুরে। এই কাচারিতে রাজার জন্য বিশেষ একটি আসন বা গদি রক্ষিত ছিল। জমিদারির প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তাকে দিউয়ান বলা হতো। যার অধীনে ছিল একজন উপ-দিউয়ান, কয়েজন নায়েব ও গোমস্তা। জমিদারির বিভিন্ন এলাকার জন্য দিউয়ান খানায় আলাদা আলাদা ডেস্ক ছিল এবং প্রতিটি ডেস্কের জন্য বিভিন্ন ধরণের বেশ কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছিল।
রাজা কালি নারায়ণ রায় চৌধুরীর স্বর্ণময়ী নামে একজন সৎবোন ছিল। কুলিন পাত্র ছাড়া রাজ পরিবারের কোন মেয়েকে বিয়ে দেয়ার রেওয়াজ ছিল না। রায় পরিবারের মেয়েদের বিয়ের পর জামাইদের প্রায় সবাইকে ঘরজামাই হিসেবে রাজবাড়িতে রেখে দেয়া হতো। অবশ্য স্বর্ণময়ী তার বিয়ের কয়েক বছর পরেই স্বামী ও কন্যাদের নিয়ে রাজবাড়ি ছেড়ে আলাদা বাড়িতে উঠেছিলেন। তিনি মারা যান ১৯১৭ সালে। স্বর্ণময়ীর কমলকামিনী ও মোক্ষদা নামে দুটি মেয়ে ছিল। ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলার আগেই মোক্ষদা ফণী নামে এক পুত্র ও শৈবালিনী নামে এক কন্যা রেখে মারা যান। ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলায় কমলকামিনী মেজো কুমারের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। অপর দিকে মোক্ষদার পুত্র ফণী ও কন্যা শৈবালিনী সাক্ষ্য দিয়েছিলেন ১নং বিবাদি অর্থাৎ বিভাবতীর পক্ষে। তারা সাক্ষ্য প্রদানকালে ই”ছাকৃতভাবে অনেক তথ্য গোপন করেছিলেন। রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণের গায়ের রং ছিল হলদে। তাঁর ছিল বিরাট একজোড়া পুর”ষ্ঠ গোঁফ। তিনি বিদ্যালয়ের শিক্ষা বিশেষ লাভ না করলেও ভাল ইংরেজি জানতেন এবং ইংরেজ সাহেবদের সংগে মিশতে পারতেন। ইংরেজদের সাথে কথা বলতেন ইংরেজিতে। কিন’ বাঙালি ব্রাহ্মণদের মতোই স্বাভাবিক জীবন যাপন করতেন। প্রতি বছর জয়দেবপুর রাজবাড়িতে অনুষ্ঠিত হতো দুর্গা পুজা, কালি পূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, বাসন-ী পূজা ইত্যাদি। এছাড়া পালন করা হতো রথযাত্রা উৎসব। রাজবাড়ির পুর”ষদের সাহেব-সুবাদের সাথে মেলা-মেশা থাকলেও মেয়েরা ছিলেন পর্দানশীন। রাজবাড়ির অন্দর মহলে বাইরের পুর”ষদের প্রবেশাধিকার ছিল না।
সরকারি নথিপত্রে দেখা যায় ১৮৯৭ সালের প্রচণ্ড ভূমিকম্পের ফলে জয়দেবপুর রাজবাড়ির নানা অংশে ফাটল ধরেছিল। সেই কারণে রাজবাড়ি ও রাজবিলাশের নতুন করে সংস্কার করা হয়েছিল। যখন রাজবাড়ির এই সংস্কারের কাজ চলছিল, সেই সময়ে হঠাৎ একদিন রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী অসুস’ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার জন্য তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকায়। কিন’ শত চিকিৎসা ও চেষ্টা সত্ত্বেও তিনি আর সুস’ হয়ে উঠেননি। ১৯০১ সালের ২৬ এপ্রিল ঢাকায় নলগোলার বাড়িতে ম