ভাওয়াল রাজ বংশ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি তিন পুত্র যথাক্রমে রণেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি, রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি ও রবীন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি এবং তিন কন্যা যথাক্রমে ইন্দুময়ী দেবী, জ্যোতির্ময়ী দেবী এবং তড়িম্ময়ী দেবীকে রেখে ১৯০১ সালের ২৬ এপ্রিল মৃত্যু বরণ করেন। রাজ কুমারগণ নাবালক থাকায় তাঁদের মা রাণী বিলাসমণি দেবী ট্রাস্টি হিসেবে এস্টেটের পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন। ১৯০৭ সালে রাণী বিলাসমণির মৃত্যুর পর তিন ভ্রাতা সমান হিস্যায় জমিদারির মালিকানা স্বত্ব লাভ করেন। রাজকুমারগণ ছিলেন মুর্খ, মদ্যপ ও অমিতাচারী। খারাপ মেয়েছেলেদের সংসর্গে থাকার কারণে মেজোকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হন। ঘরে তাঁর স্ত্রী বিভাবতী দেবী থাকা সত্ত্বেও বেশ্যালয়ে গমন থেকে বিরত থাকেননি। স্থানীয় পর্যায়ে ও কোলকাতায় চিকিৎসা গ্রহণের পরও রোগমুক্ত না হওয়ায় শ্যালক সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী ও রাজ পরিবারের পারিবারিক চিকিৎসক ডাঃ আশুতোষ দাসগুপ্তের পরামর্শে ভ্রমণ, হাওয়া বদল ও চিকিৎসা লাভের উদ্দেশ্যে ১৯০৯ সালের ১৮ এপ্রিল স্ত্রী বিভাবতী দেবী, শ্যালক সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, পারিবারিক চিকিৎসক ডাঃ আশুতোষ দাসগুপ্ত, কুমারের প্রাইভেট সেক্রেটারি মুকুন্দ গুঁই, আরদালি শরীফ খাঁ পাঠান, গুর্খাগার্ড হরিসিংহ, হিসাব রক্ষক বীরেন্দ্র ব্যানার্জীসহ ২৭ জনের এক লটবহর নিয়ে মেজোকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে জয়দেবপুর ত্যাগ করেন। দার্জিলিং-এ শ্যালক সত্যেন্দ্রনাথ ও প্রাইভেট সেক্রেটারি মুকুন্দগুঁই কর্তৃক পূর্বেই ভাড়া করা ২০১, রণজিত রোডের স্টেপএসাইড নামক বাড়িতে লটবহর নিয়ে উঠলেন রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি। এখানেই শুরু হলো ধুরন্ধর সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর ষড়যন্ত্র। তাকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এলো ডাঃ আশুতোষ দাস গুপ্ত।
রমেন্দ্র নারায়ণ সিফিলিসের রুগী হলেও শারীরিক ভাবে সুস্থই ছিলেন। ক’দিন আগে একটি মানুষ খেকো বাঘ শিকার করে কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। হঠাৎ ৫ মে তাঁর পেট ফুলে উঠলো। শুরু হলো পেটে ব্যাথা। ঘুম থেকে ডেকে উঠানো হলো ডাঃ আশুতোষকে। ডাঃ আশুতোষ মেজোকুমারের পেট পরীক্ষা করলেন, কিন্তু কোন ঔষধ দিলেন না। ৬ মে সকালে দার্জিলিং এর সিভিল সার্জন ইংরেজ ডাঃ টেলফার কেলভার্টকে ডাকা হলো। তিনি পেট ফাঁপা রোগের চিকিৎসা করলেন। দার্জিলিং হতে বড়কুমারের নিকট জয়দেবপুরে প্রেরিত দুই/ তিনটি টেলিগ্রামে দেখা যায় রমেন্দ্র নারায়ণের পেট ব্যথা সেরে উঠেছে, জ্বরও নেই। ৭ মে রাতে ডাঃ আশুতোষ দাসগুপ্ত দার্জিলং এর সিভিল সার্জনের সাথে আলোচনা না করে নিজে তিন বার করে খাওয়ানোর জন্য ঔষধের ব্যবস্থাপত্র দিলেন। ৮ তারিখ সকালে এবং দুপুরে টেলিগ্রাম করে জয়দেবপুরে বড়কুমার রণেন্দ্র নারায়ণকে জানানো হলো গত রাতে কুমারের সুনিদ্রা হয়েছে, জ্বর বা ব্যথা নেই। অথচ বিকেলে টেলিগ্রাম করে বড়কুমারকে জানানো হলো, ’কুমার ইস সিরিয়াসলি ইল, ফ্রি কোয়েন্টলি ওয়াটারি মোসানস উইথ ব্লাড, কাম সার্প’। বড়কুমারকে এমন সময়ে দার্জিলিংএ যেতে বলা হলো যখন ঐ দিনে যাতায়াতের আর কোন ট্রেন নেই টেলিগ্রামগুলো সুকৌশলে ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে সত্যেন্দ্রনাথ ও ডাঃ আশুতোষ কর্তৃক প্রাইভেট সেক্রেটারি মুকুন্দগুঁইয়ের বরাত দিয়ে পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে রমেন্দ্র নারায়ণের শারীরিক অবস্থা অবনতির শেষ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। দার্জিলিং এর সিভিল সার্জন ডাঃ কেলভার্ট এবং সরকারি ডাঃ নিবারণ চন্দ্র এসে চিকিৎসা করলেন। মরফিন ইনজেকশনও দেয়া হলো। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। রাত ৮টার দিকে কুমারের শরীর ধীরে ধীরে হিম শীতল হয়ে গেল। রাত ৮.৩০ টার দিকে জয়দেবপুরে টেলিগ্রাম করে মেজোকুমারের মৃত্যুর সংবাদ জানানো হলো।
ঐদিন রাতে রমেন্দ্র নারায়ণের শবদেহ পোড়ানোর পুরোহিত ও শ্মশান যাত্রী জোগাড় করে দার্জিলিং এর পুরাতন শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হলো। হিন্দু শাস্ত্রানুসারে মুখাগ্নি দেয়ার মতো কেহ উপস্থিত না থাকলে বিধবা স্ত্রী মুখাগ্নি করবে। কিন্তু মুখাগ্নির জন্য বিভাবতীকে সংগে নেয়া হলো না। মৃতদেহ পোড়ানোর উদ্দেশ্যে চিতা সাজানোর জন্য একটি ভালো জায়গা খোঁজা হচ্ছিল। এর মধ্যে শুরু হলো প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি। শ্মশান যাত্রীরা বৃষ্টির পানিতে ভিজে একাকার। একটু আশ্রয় নেয়ার জন্য মুখাগ্নির পর শবদেহ শ্মশানে রেখে তারা দৌঁড়ে চলে গেল অন্যত্র। ঝড়-বৃষ্টি কমে গেলে শ্মশান যাত্রীরা এসে আর মৃতদেহ পায়নি। মৃতদেহ খোঁজা শুরু হলো। না পেয়ে শ্মশান যাত্রীরা ফিরে গেল যার যার আস্তানায়। এ দিকে সত্যেন্দ্রনাথ এবং ডাঃ আশুতোষ শুরু করলো আরেক ষড়যন্ত্র। তারা সেই রাতে অর্থের বিনিময়ে জোগাড় করলো একটি মৃতদেহ। মৃতদেহটি খাটিয়ায় রেখে সাদা কাপড়ে আবৃত করে রাখা হলো। এর পর ৯ মে সকালে পার্শ্ববর্তী পরিচিত ও অপরিচিত লোকজনকে খবর দেয়া হলো। শবদেহ পোড়ানো ও বহনের জন্য অর্থের বিনিময়ে লোক জোগাড় করা হলো। কৌশলে পরিচিত কাউকে মৃতদেহ হতে কাপড় সরিয়ে দেখতে দেয়া হলো না। অতঃপর সকাল ৮টার দিক মৃতদেহ দার্জিলিং শ্মশানে নিয়ে দাহ করা হলো। পরিশেষে ১০ মে মধ্যরাতে মেজো কুমারের বিধবা স্ত্রী বিভাবতী দেবী, ডাঃ আশুতোষ দাসগুপ্ত, শ্যালক সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীসহ সংগীয় অন্যান্য কর্মচারীরা ফিরে এলো জয়দেবপুর।
আরদালি শরীফ খাঁ মেজোকুমারকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতো। সে ছিলো বিশ্বস্ত ভৃত্য। রমেন্দ্র নারায়ণের মৃত্যুতে সে শোকে উম্মাদ। শরীফ খাঁ রাণী সত্যভামাকে জানায় যে, সত্যেন্দ্র নাথের উপস্থিতিতে ডাঃ আশুতোষ ছোট একটি কাঁচের গ্লাসে করে ঔষধ খাওয়ালেন। অসুস্থ মেজোকুমার কিছুটা ঔষধ খেতে পারলেন, কিছুটা উগরিয়ে ফেলে দিলেন। ঔষধ খাওয়ার পর মেজোকুমার চিৎকার করে বললেন আশু, তুমি আমায় কি খাওয়ালে? ঔষধের কিছু অংশ তাঁর কাপড়ে পড়ে কাপড় পুড়ে গিয়েছিল, কিছুটা থুথু বা লালা তাঁর ডান উরুতে লেগে ঘা হয়ে গিয়েছে। শরীফ খাঁ এসব দেখালো। অনেকেই এ কথা শুনতে পেল। জ্যোতির্ময়ী দেবী শরীফ খাঁ ও বীরেন্দ্র ব্যানার্জীকে ডেকে শুনতে পেল কুমারের দেহ দাহ হয়নি। খবরটি রটে গেল চারিদিকে। অনেকেরই বিশ্বাস জন্মালো রমেন্দ্র নারায়ণের মৃতদেহ শ্মশান থেকে উধাও হয়ে গেছে এবং দাহ হয়নি। তাদের এও বিশ্বাস জন্মালো যে, কুমার মরে নাই, বেঁচে আছে। বিভাবতী দেবীর ভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী ডাক্তারি সনদ, শবদেহ দাহ করার প্রত্যয়ন পত্রসহ কয়েক জনের মৌখিক বক্তব্য দিয়ে বিশ্বাস জন্মাতে প্রয়াস পায় যে, মেজোকুমারের মৃতদেহ উধাও হয়নি; বরং যথারীতি পুড়িয়ে ফেলানো হয়েছে। এগার দিন পর মেজোকুমারের শ্রাদ্ধের দিন জ্যোতির্ময়ী দেবী, রাণী সত্যভামা দেবীসহ আরো অনেকে বেঁকে বসলেন যে, মৃতদেহ দাহিত না হলে শ্রাদ্ধ করা যায় না। শেষ পর্যন্ত ঘাস দিয়ে মেজোকুমারের কুশপুত্তলিকা বানিয়ে দাহ করে শ্রাদ্ধের কাজ সম্পন্ন করা হয়। জ্যোতির্ময়ী দেবী এবং রাণী সত্যভামার সন্দেহ থাকার কারণে তাঁরা সম্ভব্যস্থানে মেজোকুমারের খোঁজ নিতে লোক পাঠিয়ে দেন। এ দিকে সত্যেন্দ্রনাথ ঢাকায় বাড়ি ভাড়া করে তাঁর মাকে নিয়ে এলেন। তারপর মায়ের দোহাই দিয়ে জয়দেবপুর থেকে বিভাবতীকে নিয়ে এলেন ঢাকায়। বিভাবতীর অভিভাবক হিসেবে সত্যেন্দ্রনাথ মেজোকুমারের ইন্সুরেন্সের ৩০ হাজার টাকা তুলে নিলেন। আর জমিদারির এক তৃতীয়াংশের আয়ও গ্রহণ করলেন। ইন্সুরেন্সের টাকায় কোলকাতার ১৯নং ল্যান্স ডাউন রোডে নিজ নামে বাড়ি খরিদ করলেন এবং সেই সাথে দুটো গাড়িও। স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য সে বাড়িতে উঠালেন বোন বিভাবতীকে। ব্রিটিস সরকার কোর্ট আব ওয়ার্ডস আইনের আওতায় ভাওয়াল রাজ্য পরিচালনার ভার গ্রহণ করলেও রাজকুমারের বিধবা পত্নিগণ নিয়মিতভাবে ভাতা ও লভ্যাংশ পেতেন। বিভাবতীর অংশ গ্রহণ করতেন সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী। এক হিসেবে দেখা যায় ১৯০৯ সাল হতে ১৯২১ সাল পর্যন্ত ভাওয়াল এস্টেট থেকে তিনি গ্রহণ করেছেন ১৯ লক্ষ টাকা। অপর দিকে ভাওয়াল রাজ এস্টেটের এক তৃতীয়াংশ দেখভালের অভিভাবকত্ব হেতু ইংরেজ কর্মচারীদের সাথে উঠাবসার সুবাদে উপাধি গ্রহণ করেছেন রায় চৌধুরী। অর্থাৎ জমিদার সত্যেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী। ওদিকে জ্যেতির্ময়ী দেবী ও রাণী সত্যভামা দেবীর মত ভাওয়াল রাজ এস্টেটের প্রজাবৃন্দ বিশ্বাস করেন যে, মেজোকুমার বেঁচে আছেন এবং একদিন তিনি সন্ন্যাসী বেশে ভাওয়াল রাজ্যে ফিরে আসবেন। প্রকৃতপক্ষে ৮মে ১৯০৯ সালে রাতে দশ এগারটার সময়ে রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরির মৃতদেহ দাহ করার জন্য দার্জিলিং পুরাতন শ্মশানে নেয়ার পর শুরু হলো তুমুল ঝড় বৃষ্টি। সেখানে কোন আশ্রয় স্থল না থাকায় শবযাত্রীরা আশ্রয় লাভের আশায় শ্মশান ঘাট হতে দৌঁড়ে সরে গিয়েছিল।
সেরাতে দার্জিলিং শ্মশানের সন্নিকটে একটি গুহার মধ্যে ৪জন নাগা সন্ন্যাসী ধর্মালোচনায় মশগুল ছিল। বাইরে হরিবোল, হরিবোল ধ্বনি শুনতে পেয়ে সন্ন্যাসীদের গুরু লোকনাথজী দর্শন দাসকে বাইরে কি হচ্ছে দেখতে পাঠান। দর্শন দাস শ্মশানে লোকজন জমায়েত হয়েছে দেখে বিষয়টি বাবাজীকে জানান। আকাশ মেঘে ঢেকে গেল, শুরু হলো প্রচন্ড ঝড় আর বর্ষণ। অনেক রাতে বাবাজী অর্থাৎ লোকনাথ বাইরে যেয়ে লোকজন জমায়েতের বিষয়ে দেখে আসতে বলেন। তখন বৃষ্টি প্রায় থেমে গেছে। দর্শন দাস বাইরে এসে শুনতে পান যে, শ্মশান হতে কেমন একটি শব্দ উত্থিত হচ্ছে। তখন সন্ন্যাসীরা লন্ঠন নিয়ে ঘটনাস্থলে যেয়ে দেখেন যে, খাটিয়ার উপর একটি লোক শুয়ে আছে। লোকটির শরীরের উপর থেকে কাপড়টি সরিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে পান লোকটি জীবিত আছে। সন্ন্যাসীরা লোকটিকে ধরা ধরি করে গুহায় নিয়ে যান। তার ভিজে কাপড় গা থেকে খুলে শুকনো কাপড় জড়িয়ে দেন। পরদিন তাকে আরও নিচে একটি কুটিরে নিয়ে রাখে। সেখানে তার জ্ঞান ফিরলে সে কিছুই বলতে পারেনা। এরপর নাগা সন্ন্যাসীরা তাকে সংগে নিয়ে বহু অরণ্য, পাহাড়, গুহা, হিমালয় পর্বত, তিববত প্রভৃতি জায়গায় ভ্রমণ করে। লোকটি তার পরিচয় বা নাম পর্যন্ত মনে করতে পারে না। সে কারণে তার পরিচিতির জন্য ডান বাহুতে উর্দু অক্ষরে উল্কি দিয়ে লিখে রাখেন ’’বাবা ধরম দাসকা চেলা নাগা’’ অর্থাৎ সন্ন্যাসী বাবা ধরম দাসের নাগা চেলা। পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল, নগর-জনপদ ঘুরতে ঘুরতে একদিন ১৯২১ সালের ৪মে ঐ চেলা নাগা সন্ন্যাসী ঢাকায় উপস্থিত হন। ঢাকা শহরের এক প্রান্তে সদর ঘাটের পূর্বদিকে বাঁধের উপর সন্ন্যাসীদের আখড়ায় এক সকালে নতুন সন্ন্যাসীকে বসে থাকতে দেখা গেল। মাত্র পঁয়ত্রিশ/ চল্লিশ বছর সয়সী সন্ন্যাসী, সর্ব শরীর উদাম, লেংটি পরিহিত, সারা দেহ ভস্মাচ্ছাদিত, মাথায় প্রলম্বিত চুলের জটা, দাড়ি গোঁফে মুখাচ্ছাদিত। নতুন সন্ন্যাসীকে দেখার জন্য মুহূর্তের মধ্যে ভিড় জমে গেল। ভক্তরা পদধুলি নেয়, সন্ন্যাসী মুদিত নয়নে ঈশ্বরের কাছে মঙ্গল কামনা করে, আর আশীর্বাদ দিয়ে হাতে তুলে দেয় একটি এলাচ দানা। দর্শনার্থীদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হলো। অনেকেই বলতে লাগল এ যে ভাওয়ালের মেজোকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী। সন্ন্যাসী নিজের পরিচয় দেয় না, কথা বলে না। খবর পৌঁছে গেল কাশিমপুরের জমিদার অতুল প্রসাদ রায় চৌধুরীর কাছে। তিনিও এলেন। সন্ন্যাসীকে দেখতে অবিকল মেজোকুমারের মত। এ বিষয়ে প্রশ্ন করে কোন জবাব মেলে না। কিছু দিন পর অতুল প্রসাদ তাঁর পুত্রের যজ্ঞ উপলক্ষে সন্ন্যাসীকে নিয়ে এলেন কাশিমপুর। জয়দেবপুর হতে কাশিমপুর বেশী দূরে নয়। এ নতুন সন্ন্যাসীর আগমন বার্তা পৌঁছে গেল মেজোবোন জ্যোতির্ময়ী দেবীর কাছে। অতুল প্রসাদ সন্ন্যাসীকে হাতির পিঠে বসিয়ে পাঠিয়ে দিলেন জয়দেবপুর। দূর-দূরান্ত হতে প্রজারা ছুটে এলো সন্ন্যাসীকে এক নজর দেখার জন্য। যে দেখে সেই বলে, এইতো মেজোকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ। নিয়ে যাওয়া হলো রাজবাড়িতে। বিলাস মণি উচ্চ বিদ্যালয়, মাবধবাড়ি, জয়দেবপুরের গাছপালা, রাস্তাঘাট, রাজবাড়ি এসব দেখে সন্ন্যাসীর ভাবান্তর হতে থাকে–ধীরে ধীরে তাঁর লুপ্ত স্মৃতি জাগরিত হয়ে উঠে। বোন জ্যোতির্ময়ী, রাণী সত্যভামা দেবী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন সন্ন্যাসীকে। সেই অবয়ব, সেই চক্ষুদ্বয়, কান, ওষ্ঠ, শরীর, হাত-পা, মুখের গঠন ইত্যাদি। এ এক কঠিন সমস্যা। সন্ন্যাসী নিজে কিছু বলেন না-বাংলাও বোঝেন না। জ্যেতির্ময়ী দেবী অতীত স্মৃতি তুলে ধরে–সে যে তাদের মেজোকুমার তা স্বীকার করতে বলেন। সন্ন্যাসী গর্জে উঠেন–নেই, নেই হাম, তোমারা কৈ নেহি হ্যায়। ভাওয়ালের প্রজাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে এক নজর দেখার জন্য লোকজন ছুটে আসে। এক বিরাট গণজমায়েত সৃষ্টি হয়। হাজার হাজার মানুষ সন্ন্যাসীকে চিনতে পারে, তারা এক বাক্যে স্বীকার করে সন্ন্যাসীই হারিয়ে যাওয়া মেজোকুমার। ধীরে ধীরে সন্ন্যাসীর হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি, কথা, ছবি, চোখের ও মনের পর্দায় ভেসে উঠতে থাকে। মনে পড়ে দার্জিলিংএ ডাঃ আশুতোষ কর্তৃক বিষ প্রয়োগের কথা, মনে পড়ে চেতনা ফিরে পেয়ে নিজেকে কয়েকজন নাগা সন্ন্যাসীর মধ্যে আবিষ্কার করার কথা। নিজ পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে সন্ন্যাসীরা তা বলে না বা বলতেও পারে না। তারপর ১২ বছর যাবৎ সন্ন্যাসীদের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছে কত গহীন বন-জঙ্গল, নগর, জনপদ, হিমালয়, গিরি-গুহা, তিববত আর নেপাল। পুরাতন রাজবাড়ি, রাস্তাঘাট, স্কুল, মাধববাড়ি, ঠাকুরমা, বোন জ্যেতির্ময়ী আর চেনা-জানা লোকগুলো ক্রমশঃ চেনা চেনা মনে হয়। চিনতে পারে ব্যবহার্য্য জিনিসপত্র। বোন জ্যেতির্ময়ী আর ঠাকুরমা রাণী সত্যভামা দেবী মেজোকুমারের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য অনুনয় বিনয় করে আবেদন করেন ঢাকার কালেক্টর বাহাদুর লিন্ডসের কাছে, কোর্ট অব ওয়ার্ডসের মালিক বোর্ড অব রেভিনিউ এর কাছে। সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সে বিভিন্ন প্রকার সার্টিফিকেট আর সাক্ষ্য যোগাড় করে বোর্ড অব রেভিনিউ এবং ঢাকার কালেক্টরকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, সন্ন্যাসী একজন প্রত্যারক, ঠগ ও জোচ্চোর। সে একজন নাগা সন্ন্যাসী। জ্যোতির্ময়ী দেবীসহ আরো কয়েকজনে মিলে মেজোকুমারের ন্যায় দেখতে সন্ন্যাসীকে মেজোকুমার সাজিয়ে জমিদারি করতলগত করে আত্মসাত করতে চায়। প্রজাসাধারণ মেনে নিতে চায় না এ ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। তারা রুখে দাঁড়ায়। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায় বাবর আলী। সন্ন্যাসীকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে জয়দেবপুর গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে কালেক্টর লিন্ডসে। ইংরেজ সরকার ভয় পেয়ে যায় সন্ন্যাসীকে। এস্টেটের কর্মচারীদেরকে ভয় দেখায় যাতে তাকে কেউ সমর্থন না করে। প্রজাদের করে ফেলে দ্বিধাভক্ত। সন্ন্যাসীকে কোলকাতায় নিয়ে যাওয়া হলো। এখানে সে ভাওয়াল রাজপুত্র হিসেবে চলাফেরা করে। বিভাবতীকে দেখার জন্য ছুটে যায় ১৯নং ল্যান্স ডাউন রোডের বাড়ির সন্নিকটে। বিভাবতী সন্ন্যাসীকে কোলকাতার আরো কয়েক স্থানে দেখতে পেল। কিন্তু, স্বামী যে তার জীবিত আছে এ কথা স্বীকার করলো না। বরং ভাইয়ের পক্ষাবলম্বন করলো। এছাড়া তাঁর উপায়ও ছিল না।
এর নয় বছর পর ১৯৩০ সালের ২৪ এপ্রিল সন্ন্যাসী বাদি হয়ে ঢাকার প্রথম সাব জজ আদালতে তাঁর বেঁচে থাকার বিষয়ে স্বীকৃতি আদায় ও সম্পত্তির অংশ ফিরে পাওয়ার দাবিতে রুজু করলেন মামলা নম্বর ৭০/১৯৩০। মামলার মূল বিবাদি শ্রীমতি বিভাবতী দেবী, পক্ষে কোর্ট অব ওয়ার্ডসের ম্যানেজার মি. ই.বিগ নোল্ড। মামলার অপরাপর বিবাদি হলেন বড় রাজকুমারের বিধবা স্ত্রী সরযূবালা দেবী, ছোট কুমারের বিধবা স্ত্রী আনন্দ কুমারী দেবী ও দত্তক নাবালক রাম নারায়ণ রায়, পক্ষে কোর্ট অব ওয়ার্ডসের ম্যানেজার মি. ই. বিগ নোল্ড। বাদির দাবি রমেন্দ্র নারায়ণ হিসেবে নিজের স্বীকৃতি, সম্পত্তির দখল প্রাপ্তি ও মূল প্রতিবাদিনির উপর চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি।
বিবাদি পক্ষের জবাব, আরজি সংশোধন, জবাব সংশোধন ইত্যাদি প্রক্রিয়া শেষে ১৯৩৩ সালে মামলাটি শুনানির জন্য প্রস্ত্তত হয়। অতঃপর মামলাটি দেওয়ানী মামলা নম্বর ৫/১৯৩৩ এ রূপান্তরিত হয়ে প্রথম সাব জজ আদালতে শুনানির জন্য গৃহীত হয়। আদালতের বিচারক সাব জজ জনাব পান্নালাল বসু এম.এ. বি.এল। পান্না লাল বসুর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা আইনী বিশ্লেষণ, কর্মনিষ্ঠা ও সততা ছিল প্রশ্নাতীত। স্থানীয় লোকজন তাঁর বিচার কার্য ও সততায় মুগ্ধ হয়ে বলতো, ’সতী মায়ের পুত্র যারা, ঘুষের টাকা নেয় না তারা’। ১৯৩৩ সালের ২৭ নভেম্বর সাব জজ জনাব পান্নালাল বসু ভুবন বিখ্যাত আড়োলন সৃষ্টিকারী মামলাটি শুনানি শুরু করলেন। ইতিহাসে মামলাটি ’ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা’ নামে খ্যাত। মামলাটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে তিনি ছুটির দিন ব্যতীত একাদিকক্রমে মামলাটির শুনানি গ্রহণপূর্বক ১৯৩৬ সালের ২১ মে শেষ করেন।
মামলাটির বাদি পক্ষের প্রধান কৌশলী ছিলেন বি.সি চ্যাটার্জী, ব্যারিষ্টার-এট-ল। অপর দিকে বিবাদি পক্ষের প্রধান উকিল ছিলেন এ এন চৌধুরী, বার-এট-ল। মামলার গুরুত্ব বিবেচনা করে সত্য উদ্ঘাটনের জন্য বাদি পক্ষের ১০৬৯ জন এবং বিবাদি পক্ষের ৪৭৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। সাক্ষীদের মধ্যে দেশীয় ও ইউরোপীয় অনেকেই ছিলেন সমাজের উচ্চস্তরের এবং উচ্চ পদের মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। হাতের লেখা, ফটো, শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গ ইত্যাদি প্রমাণের জন্য দেশী-বিদেশী অনেক বিশেষজ্ঞকে সাক্ষী হিসেবে আদলতে উপস্থাপন করা হয়। মামলাটির প্রতিদিনের কার্যক্রম ঢাকা ও কোলকাতার পত্রিকাসমূহে সবিস্তারে প্রকাশিত হতো। শুনানির দিন বিভিন্ন দূরবর্তী এলাকা হতে হাজার হাজার মানুষ স্বেচ্চায় আদালত প্রাঙ্গণে হাজির হয়ে গভীর আগ্রহ নিয়ে প্রতীক্ষা করতো। এ মামলাটি ভারতবর্ষ পেরিয়ে সুদূর ইংরেজ মুল্লুকেও আড়োলন সৃষ্টি করেছিল। শুনানিকালে পান্নালাল বসু ছিলেন সাব জজ। কিন্তু তিন বছর পর রায় প্রদানকালে পদোন্নতি পেয়ে হয়েছিলেন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ। মামলা প্রমাণ বা মিথ্যা প্রমাণের জন্য আদালতে ফটো ও নানাবিধ দলিল দস্তাবেজসহ দুই হাজার প্রদর্শনী উপস্থাপিত হয়েছিল। শুনানি শেষে তিন মাস দুই দিন পর ২৪ আগষ্ট বিচারক পান্নালাল বসু জনাকীর্ণ আদালতে ৫৩২ পৃষ্ঠার টাইপ করা এই ঐতিহাসিক মামলার রায় ঘোষণা করেন। তিনি তাঁর ইতিহাস বিখ্যাত রায়টির শেষাংশ পাঠ করে শুনানোর সময় বলেন, ’আমি ঘোষণা করছি যে, এই বাদিই ভাওয়ালের প্রয়াত রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায়ের দ্বিতীয় পুত্র রমেন্দ্র নারায়ণ রায়। আমি আমার রায়ে আরো ঘোষণা করছি যে, তাঁর পিতার সম্পত্তিতে তাঁর অংশীদারিত্ব আছে এবং এই আদেশ দিচ্ছি বিবাদি পক্ষ যে যে সম্পত্তি ভোগ করছেন সে সম্পত্তির একতৃতীয়াংশ সম্পত্তি যা তারা দখল করেছেন, তাঁর দখল যেন বাদিকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। বিবাদীগণের মধ্যে যারা কুমারের বিরোধিতা করেছেন, মামলা চালিয়েছেন তাঁরা শতকরা ছয় টাকা হারে সুদসহ তাঁকে মামলার খরচ দিবেন’।
রায় শুনে আনন্দে কেঁদে উঠলেন মেজোকুমার। বারবার উচ্চারণ করলেন ফিরিয়ে দাও আমার হারানো সোনালী ২৪ বছর। ভাওয়ালের প্রজাবৃন্দ আনন্দে ফেটে পড়লো। অবশেষে সত্যের জয় হলো।
এই মামলায় মেজোকুমারের স্ত্রী বিভাবতী হারানো স্বামীকে চিনতে পেরেও না চেনার ভান করে ভাইয়ের পক্ষ অবলম্বন করেছিল। ছোট কুমারের বিধবা স্ত্রী আনন্দ কুমারী দেবীও বিপক্ষে সাক্ষ্য দেয়।
যাহোক বিবাদী পক্ষ এই রায়ের বিরুদ্ধে কোলকাতা হাইকোর্টে আপিল মামলা রুজু করেন। তিনজন বিজ্ঞ বিচারপতি যথাক্রমে জাস্টিস চারু চন্দ্র বিশ্বাস, জাস্টিস কাস্টিলো ও জাস্টিস লজ শুনানীর শেষে প্রথম দুজন পান্নালাল বসুর রায়ের সাথে একমত পোষণ করেন। হাইকোর্টেও পরাস্ত হন বিবাদী পক্ষ। এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলকারীরা প্রিভি কাউন্সিলে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে হাইকোর্টে স্পেশাল লিভ টু আপিল দায়ের করার অনুমতি চেয়ে প্রার্থনা করেছিলেন। লিভ পিটিশনটি শুনানির জন্য বিচারপতি মি. জাস্টিস মিত্র, মি. জাস্টিস খান্দেকর এবং মি. জাস্টিস পলকে নিয়ে গঠিত হয়েছিল বেঞ্চ। দশ দিন শুনানির পর ১৯৪২ সালের ৩০ জুন হাইকোর্ট লিভ টু আপিল পিটিশনটি খারিজ করে দেন। মাননীয় বিচারপতিরা আবেদনকারীদের সব প্রশ্নের বিবেচনার পরই সবাই একমত হয়ে বলেছিলেন, “For the reasons given above we refuse Certificate and dismiss the application of the petitioners for leave to Appeal to his Majesty in council with costs to the plaintiff opposite party. Hearing fee is assessed at thirty gold mohurs.”
প্রিভি কাউন্সিলে লিভ টু আপিল দায়েরের জন্য যে লিভ পিটিশনটি বিবাদি পক্ষ হতে দাখিল করা হয়েছিল তা তুলে নেয়ার জন্য বিবাদি পক্ষ আবেদন করলে হাইকোর্ট তা মঞ্জুর করে শেষ পর্যন্ত আদেশ দিয়েছিলেনঃ
“We allow to withdraw the application without prejudice to right to make further application that the petitioners might be advised to make, if and when an application for special leave to his majesty in council is made.”
এ ভাবেই ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলার সমাপ্তি ঘটেছিল। মামলাটি সম্পর্কে তখনকার Calcutta weekly note, Times সহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার মন্তব্য ছিল “Strange but true.”
ভাওয়াল সন্ন্যাসীর এই মামলার কাহিনীকে উপজীব্য করে গ্রন্থিত হয়েছে অসংখ্য উপন্যাস, নাটক আর তৈরী হয়েছে সিনেমা। এখনো থেমে নাই কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার এবং চিত্র নির্মাতারা। এই ঐতিহাসিক মামলার যুক্তিগ্রাহ্য রায় ভারতের ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের নানা দেশে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।