Wellcome to National Portal
ভূমি সংস্কার বোর্ড গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

সর্ব-শেষ হাল-নাগাদ: ২৭ এপ্রিল ২০১৬

ঢাকা নওয়াব এস্টেটের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

ঢাকা নামের উৎপত্তি

অন্যান্য স্থানের ন্যায় ঢাকার নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা মত। এসব মতের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিম্নরূপঃ

ক.২.১. ঢাক বা ঢাকি হতে ঢাকা

বাংলাদেশের এ অঞ্চলে প্রচুর ঢাক বা ঢাকিগাছ (বৈজ্ঞানিক নাম বুটিফ্রনডোসা) জন্মাতো। ঢাক বা ঢাকিগাছের আধিক্য হেতু এলাকাটির নাম হয় ঢাকা।

ক.২.২. দেবী দুর্গার গুপ্ত বা ঢাকা অবস্থায় থাকার কারণে ঢাকা

দেবী দুর্গা গুপ্তস্থানে লুকায়িত ছিলেন। ভক্তরা খনন কালে এ স্থানে দেবীকে আবিষ্কার করেন। গুপ্তস্থান বা ঢাকা অবস্থান হতে দেবীকে এস্থানে (ঢাকা-ঈশ্বরী) পাওয়া যায় তাই নাম হয় ঢাকা। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ঢাকেশ্বরী মন্দির স্থাপনের মধ্য দিয়ে।

ক.২.৩. ঢাক বা ড্রাম বাজানো থেকে ঢাকা

কথিত আছে মুঘল সুবাদার ইসলাম খান ১৬১০ সালে এ স্থানে প্রাদেশিক (সুবাহ) রাজধানী উদ্বোধনের দিন ঢাক বা ড্রাম বাজিয়ে আনন্দ উৎসব করেছিলেন। এই ঢাক বাজানোকে কেন্দ্র করে স্থানটির নাম হয় ঢাকা।

ক.২.৪. ঢাকাইয়া উপ ভাষা হতে ঢাকা

এককালে ঢাকাইয়া উপভাষা বা ঢাকা ভাষা নামে একটি উপ ভাষার প্রচলন ছিল। এখনো ঢাকার আদিবাসিন্দাদের মধ্যে ঢাকাইয়া ভাষার প্রচলন রয়েছে। এই উপভাষায় কথা বার্তা বলার জন্য স্থানটিকে ঢাকা নামে অভিহিত করা হয়।

ক.২.৫. ঢাক্কা শব্দ হতে ঢাকা

রজত রঙ্গিণীতে ঢাক্কা শব্দটি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এখান হতে বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী এলাকা পর্যবেক্ষণ করা হতো বিধায় ঢাক্কা শব্দ হতে নামকরণ হয়েছে ঢাকা। এমতালম্বীরা প্রমাণস্বরূপ ইংরেজিতে ঢাকাকে Dacca লেখার কথা উপস্থাপন করে থাকেন। 

ক.২.৬. পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ডবাক হতে ঢাকা

এলাহাবাদ শিলা লিপিতে সমুদ্র গুপ্তের আমলে ডবাক নামে পূর্বাঞ্চলের একটি রজ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই ডবাক রাজ্য হতে ঢাকার উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। আর ডবাক রাজ্যটি এ এলাকায় অবস্থিত ছিল।

ঢাকার স্থান নাম নিয়ে আরো মতবাদ থাকতে পারে। তাবে, ঢাক বা ড্রাম বাজিয়ে মুঘল সুবাদার ইসলাম খান কর্তৃক প্রাদেশিক রাজধানীর উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে ’ঢাকা’ নামের উৎপত্তি যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়।

 

ঢাকার অবস্থান

বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। পৃথিবীর জনবহুল নগরীর মধ্যে এটি অন্যতম। এর রয়েছে এক গৌরবময় সংগ্রামী ইতিহাস। জেমস টেলর ১৮৩৯ সালে ’Topography of Dacca’ রিপোর্টে ঢাকা জেলার অবস্থান সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, ’এ জেলা প্রধানতঃ ২৩ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ থেকে ২৪ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা বিধৌত এই জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের শাসনাধীন। এর আকৃতি ত্রিভূজের ন্যায় এবং ভূমি পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত এবং এর চূড়াটি ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার সঙ্গমস্থলের দিকে প্রসারিত। এ জেলার উত্তরে ময়মনসিংহ, দক্ষিণে বাকেরগঞ্জ, পূর্বে ত্রিপুরা ও পশ্চিমে ফরিদপুর বা ঢাকা জালালপুর জেলা দ্বারা পরিবেষ্টিত’’।

ইংরেজ আমলে ১৭৭২ সালে ঢাকা জেলার সৃষ্টি হয়েছিল। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ঢাকা জেলা ঢাকা সদর, মাণিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও গাজীপুর মহকুমার সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। পরবর্তীতে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ফলে প্রত্যেকটি মহকুমা স্বতন্ত্র জেলায় রূপান্তরিত হয়। বর্তমান ঢাকা  জেলার প্রশাসনিক কার্যক্রম ঢাকা সিটি কর্পোরেশনসহ ধামরাই, দোহার, নবাবগঞ্জ, সাভার ও কেরাণীগঞ্জ উপজেলা সমন্বয়ে পরিচালিত হচ্ছে। ঢাকা জেলার উত্তরে গাজীপুর ও টাঙ্গাইল জেলা, দাক্ষিণে মুন্সীগঞ্জ ও শরিয়তপুর জেলা, পূর্বে নারায়ণগঞ্জ জেলা এবং পশ্চিমে মাণিকগঞ্জ জেলা। ঢাকা জেলার বর্তমান আয়তন ১৪৬৩.৬০ বর্গকিলোমিটার।

 

ঢাকার নওয়াব পরিবার

মুঘল আমলে ঢাকার নবাব অধ্যায়ে ১৬১০ সাল হতে ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত মুঘল সম্রাটগণ কর্তৃক নিযুক্ত সুবেবাংলা তথা ঢাকার নবাব এবং নায়েবে-নযিমগণের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে। উল্লেখিত নবাব এবং নায়েবে-নাযিমগণ ঢাকার শ্রীবৃদ্ধি সাধনে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন- যা পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে। আমরা এবার ঢাকার নবাব পরিবার সম্পর্কে আলোকপাত করবো। আলোচনাধীন নবাবগণ মুঘল আমলের খানদানি নবাব নন। ব্রিটিস সরকার প্রদত্ত নবাব খেতাবধারী এই নবাব পরিবার পাক ভারত উপমহাদেশের রাজনীতি ও সমাজ সেবায় এক অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। বলতে গেলে সিপাহি বিদ্রোহ তথা বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের পর হতে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত প্রত্যেকটি আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এই নবাব পরিবার। অবশ্য আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তার এক প্রবন্ধে ঢাকার এই নবাবদের ’কাগুজে নবাব’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিশিষ্ট ইহিতাসবিদ ও গবেষক মুনতাসির মামুন ’’ঢাকার কাগুজে নবাব’’ প্রবন্ধে খাজা আলিম উল্লাহ বা আলি মিয়াকে ঢাকার নবাব বংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অপরদিকে জনাব মোঃ আলী আকবর বাংলা পিডিয়ার ৪র্থ খন্ডে ঢাকা নবাব পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে খাজা হাফিজ্জুল্লাহ এবং তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র খাজা অলিম উল্লাহ এর নাম উল্লেখ করেছেন।

নবাব পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা বা পত্তনদার নিয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে। লোকনাথ ঘোষের মতে, কাশ্মির থেকে খাজা আব্দুল হাকিম রাজ কর্মচারী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন দিল্লিতে। নাদির শাহ দিল্লি আক্রমণ করলে তিনি সিলেটে এসে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেছিলেন। ব্যবসার বিস্তার ঘটলে তিনি নিকট আত্মীয় আব্দুল কাদির এবং তাঁর পুত্র আব্দুল্লাহ ও ওয়াহাবকে কাশ্মির থেকে সিলেটে চলে আসতে অনুরোধ জানান। আব্দুল হাকিম মারা গিয়েছিলেন সিলেটে এবং তাঁকে সেখানে সমাহিত করা হয়। এরপর আব্দুল্লাহ চলে এসেছিলেন ঢাকায়। ব্রাডলি বার্ট উল্লেখ করেছেন আব্দুল্লাহ কাশ্মির থেকে দিল্লি হয়ে সিলেটে আসেন এবং ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারীরা ঢাকার বেগম বাজারে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন। অন্য একটি গ্রন্থে তিনি নবাব পরিবারের আদি প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আব্দুল হাকিমের নামোল্লেখ করেছেন।

বাকল্যান্ডও ঢাকার নবাব পরিবারের আদি প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আব্দুল হাকিমের কথা বলেছেন। তাইফুরের মতে এ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল ওয়াহাব। তাঁর দুই ভাইপো হাফিজ উল্লাহ ও আহসান উল্লাহ ঢাকার পুরাব দরওয়াজায় এসে বসবাস শুরু করেছিলেন। সম্প্রতি মুহম্মদ আব্দুল্লাহ নবাব পরিবারের ইতিহাস সম্পর্কিত দুটি অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি থেকে নতুন কিছু তথ্য উদ্ধার করেছেন। একটি পান্ডুলিপির রচয়িতা আলিম উল্লাহর ভাইপো ও জামাই ফার্সি ভাষার কবি আব্দুর রহিম সাবা (মৃত্যু ১৮৭১). তাঁর অপ্রকাশিত পান্ডুলিপির নাম তারিখ-ই-কাশ্মিরিয়ান-ই-ঢাকা। এ পান্ডুলিপিতে তিনি বলেছেন, খাজা হাকিম ছিলেন কাশ্মিরের শাসনকর্তা। কোন এক কারণে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে তিনি দিল্লি যাত্রা করেন। যাত্রাকালে তাঁর নিকট আত্মীয় খাজা আব্দুল্লাহ ও খাজা আব্দুল ওয়াহাবকে সফর সঙ্গী হতে অনুরোধ জানান। তাঁরা রাজি হননি। নতুন শাসনকর্তা এসে তাঁদের হেনস্তা শুরু করলে তাঁরা ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করেন। আব্দুল ওয়াহাব ’’সামুদ্রিক কুকুরের চামড়ার’’ ব্যবসা করতেন । ছোট ভ্রাতা আব্দুল্লাহ ছিলেন একজন আলেম।

ইতোমধ্যে খাজা হাকিম ঢাকায় বেগম বাজারে এসে বসবাস শুরু করেন।  এরপর খাজা ওয়াহাব ও আব্দুল্লাহর পিতা আব্দুল কাদের ঢাকায় চলে আসেন। তিনি আব্দুল হাকিমের কন্যা আশুরী খানমকে বিয়ে করেন। এটা ছিল তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে। আব্দুল্লাহর পাঁচ ছেলে মেয়ের মধ্যে বড় ও মেজো ছিলেন আহসান উল্লাহ ও হাফিজ উল্লাহ। আহসান উল্লাহর তিন ছেলের মধ্যে কনিষ্ঠ আলিম উল্লাহকে বলা যায় নবাব পরিবারের  আসল প্রতিষ্ঠাতা। তাওয়ারিক-ই-খানদান-ই-কাশ্মিরিয়া নামক পান্ডুলিপির লেখক নবাব আহসান উল্লাহ নিজ  পরিবার সম্পর্কে একই রূপ বর্ণনা দিয়েছেন। জনাব মুনতাসির মামুন মনে করেন যে আব্দুল হাকিম খুব সম্ভব কাশ্মিরের শাসনকর্তা ছিলেন না। মূলতঃ এই পরিবারটি ছিল চামড়া ও গাজা ব্যবসায়ী। নিজেদেরকে অভিজাত শ্রেণীর মর্যাদা দানের জন্য দু’জনই আব্দুল হাকিমকে শাসনকর্তা হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন।

এসব তথ্য থেকে আমরা বলতে পরি যে কাশ্মির হতে খাজা আব্দুল হাকিম অষ্টাদশ শতকের তৃতীয় দশকে সিলেটে এসে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেছিলেন। এই সময়ে খাজা আব্দুল ওয়াহাব ও আব্দুল্লাহ এই দুই ভাইও সিলেটে আসেন। কিছুদিন পর আব্দুল কাদির (দুই ভায়ের পিতা) সিলেটে আসেন এবং বিয়ে করেন আব্দুল হাকিমের মেয়ে আশুরী খানমকে। আব্দুল ওয়াহাবের একমাত্র পুত্র খলিল উল্লাহ উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপন করে তাঁর সম্পদ প্রায় উড়িয়ে দেন। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আব্দুল্লাহ বিয়ে করেছিলেন সিলেটের আর এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী কাশ্মিরি খাজা আব্দুল সালামের মেয়েকে। এরপর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। আব্দুল্লাহর বড় ছেলে আহসান উল্লাহ বিয়ে করেছিলেন আব্দুল হাকিমের এক পৌত্রী ফাতেমা খানমকে। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র আলিম উল্লাহ মানুষ হয়েছিলেন চাচা হাফিজ উল্লাহর নিকট। আলিম উল্লাহর পুত্র আব্দুল গণিই এ পরিবারের প্রথম ব্যক্তি যিনি তাঁর প্রভুভক্তি, ব্যক্তিত্ব, দক্ষতা ও যোগ্যতা বলে ইংরেজদের নিকট হতে ১৮৭২ সালে নবাব উপাধি লাভ করেছিলেন। ইংরেজরা পুরুষানুক্রমে নবাব উপাধি ব্যবহারের অনুমতিও দিয়েছিল।

 

ঢাকা নবাব এস্টেট

ঔপনিবেশিক যুগে পূর্ব বাংলার সবচেয়ে বৃহৎ জমিদারি। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খাজা হাফিজুল্লাহ এবং তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র খাজা আলীমুল্লাহ। তবে জমিদারিটির বিকাশ, বৃদ্ধি, জামিদারি ব্যবস্থাপনা এবং এস্টেটের সম্পদ ও ক্ষমতাবৃদ্ধিতে যাদের সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে তাঁরা হলেন এ পরিবারটির অধস্তন সদস্য খাজা আবদুল গণি এবং তাঁর পুত্র খাজা আহসানুল্লাহ। এ পরিবারের প্রধানকে নওয়াব বলে আখ্যায়িত করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এদের সঙ্গে প্রাক্তন মুঘল শাসকবর্গ বা নওয়াবদের কোন সম্পর্ক ছিল না। তাদের এ নওয়াব উপাধি ব্রিটিস শাসকদের প্রদত্ত একটি উপাধি বা খেতাব। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগেই তারা তাদের ভূস্বামীগত অবস্থান থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী পরিবার হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বস্ত্তত, ১৯৫০ এর দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত তাদের পারিবারিক বাসস্থান আহসান মঞ্জিল ছিল সারা পূর্ব বাংলার মুসলমানদের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু।

বলা হয় যে, তাঁদের পূর্বপুরুষ ভাগ্যান্বেষণে সুদূর কাশ্মীর থেকে বাংলাদেশে আসেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে তাঁরা স্বর্ণরেণু এবং চামড়ার ব্যবসায়ী হিসেবে সিলেটে বসবাস শুরু করেন এবং সেখান থেকে ঐ শতাব্দীর শেষ ভাগে ব্যবসা বাণিজ্যের আরও সুবিধার জন্য ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করেন। ঢাকা নওয়াব এস্টেটের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যাঁর নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ করা যেতে পারে তিনি হলেন মৌলভী হাফিজুল্লাহ। ঢাকার স্থানীয় গ্রিক এবং আরমেনীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি চামড়া, লবণ এবং মশলা সামগ্রীর একটি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা শুরু করেন এবং তা থেকে বেশ অর্থ সঞ্চয় করেন।

এ সময় দেশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলার সর্বত্রই জমিদাররা যথাসময়ে খাজনা প্রদান না করার কারণে তাদের জমিদারি হারাচ্ছিল। অর্থাৎ সরকার জমিদারদের জমি নিলামে বিক্রি করে সরকারের পাওনা রাজস্ব আদায় করে নিচ্ছিল। এর ফলে চতুর্দিকে পয়সাওয়ালা লোকদের জমি কেনার হিড়িক পড়ে যায়। এ প্রেক্ষাপটেই মৌলভী খাজা হাফিজুল্লাহ কিছু জমি কেনার সিদ্ধান্ত নেন, যার মাধ্যমে তার ব্যবসা থেকে অর্জিত অর্থের নিরাপত্তাও বৃদ্ধি পায়। খুব সম্ভবত মৌলভী খাজা হাফিজুল্লাহ ময়মনসিংহ জেলার আতিয়া পরগনার (বর্তমানে টাঙ্গাইল জেলা) চার আনা অংশ নিলামে কিনে নেন। তিনি এটি ১৮০৬ সালে ৪০,০০০ টাকায় কিনে নেন।

আতিয়া পরগনার চার আনা অংশটুকু মৌলভী হাফিজুল্লাহর জন্য অত্যন্ত লাভজনক হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে জমির মালিক হিসেবে তাঁর সম্মান এবং প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। এই লাভ এবং সম্মান পাওয়ায় উৎসাহিত হয়ে তিনি সময় সময় জমি ক্রয় করতে থাকনে। একই সঙ্গে তিনি তার মূল ব্যবসাও অব্যাহত রাখেন এবং কখনই নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেন নি। হাফিজুল্লাহর সবচেয়ে সৌভাগ্যপূর্ণ ক্রয় ছিল সুন্দরবনের আইলা টিয়ারখালী ও ফুলঝুরি পরগনা। ১৮১২ সালে তিনি ৪৪০০০ একর পতিত জমির এ বিশাল পরগনা ৩৭২ টাকার অবিশ্বাস্য রকমের ক্ষুদ্র রাজস্ব প্রদানের বিনিময়ে মাত্র ২১,০০০ টাকা দিয়ে কিনে নেন। বাকেরগঞ্জের সুন্দরবন এলাকায় ফুলঝুরি পরগনাই সর্বপ্রথম পরগনা যেটির জঙ্গল পরিস্কার করা হয় এবং খুব শিগগিরই এখানে ব্যাপকভাবে কৃষিকর্ম শুরু করা হয়। ১৮৭০ এর দশকে যখন ঐ অঞ্চলে কর আরোপের বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছিল তখন দেখা যায় যে, এ পরগনা থেকে প্রায় ২,২০,৫০২ টাকার উচ্চ পরিমাণের খাজনা আদায় হয়।

খাজা হাফিজুল্লাহ মৃত্যুর পর জামিদারি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র খাজা আলীমুল্লাহ (হাফিজুল্লাহ প্রয়াত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পুত্র) এর উপর ন্যস্ত হয়। আলীমুল্লাহকে তিনি একজন বিচক্ষণ এস্টেট ম্যানেজার ও দক্ষ ব্যবসায়ী হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। খাজা হাফিজুল্লাহর মতো খাজা আলীমুল্লাহও ছিলেন একজন দারুণ উদ্যোগী ব্যক্তি এবং তিনি বেশ কিছু লাভজনক জামিদারি তার নিজের নামে ক্রয় করেন। তাঁর ক্রয়কৃত জমিদারিও তার চাচার জামিদারির সঙ্গে সংযুক্ত হয়। এ সংযোজন সম্ভব হয় তাঁর চাচার জীবিত কোন পুরুষ উত্তরাধিকারী না থাকায়। উভয়ের সংযুক্ত জমিদারি অচিরেই প্রদেশের অন্যতম বৃহত্তম জামিদারি হিসেবে আবির্ভূত হয়। তাঁর মৃত্যুর পূর্বে (১৮৫৪ সাল) আলীমুল্লাহ এ সংযুক্ত জামিদারিটিকে একটি ওয়াকফ সম্পত্তিতে রূপান্তর করার জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেন। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, এ ওয়াকফ সম্পত্তি একজন মুতাওয়াল্লি দ্বারা পরিচালিত হবে। আলীমুল্লাহর মৃত্যুর পর তার পুত্র খাজা আব্দুল গণি মিয়া যখন এ জমিদারির মুতাওয়াল্লি হন এবং এস্টেটের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখনই এ জামিদারি সমৃদ্ধির উচ্চ শিখরে পৌঁছে। তাঁর সুনিপুণ ব্যবস্থাপনা ও দক্ষ তত্ত্বাবধানে জমিদারির পরিধি আরও বিস্তৃতি লাভ করে। তাঁর সমেয় তাদের জমিদারির নিয়ন্ত্রণ ঢাকা, বাকেরগঞ্জ, ত্রিপুরা এবং ময়মনসিংহ জেলার বহু পরগনায় ছড়িয়ে পড়ে। এ বিস্তৃত জমিদারি ব্যবস্থাপনার জন্য তিনি তাঁর জমিদারিকে ২৬টি প্রশাসনিক বিভাগে (সার্কেল) বিভক্ত করেন যার ১১টি বাকেরগঞ্জে, ৪টি ত্রিপুরায়, ৪টি পশ্চিম ময়মনসিংহ ও পাবনায়, ৩টি পূর্ব ময়মনসিংহ ও সিলেটে এবং ৪টি ঢাকা জেলায় অবস্থিত। প্রতিটি প্রশাসনিক বিভাগে একটি করে কাচারি ছিল আর এ কাচারির প্রধান ছিলেন একজন নায়েব, যার অধীনে ছিলেন বেশ কিছু আমলা বা কর্মকর্তা। এভাবেই আহসান মঞ্জিল প্রাসাদ জমিদারি ব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত কেন্দ্রে পরিণত হয়। জমিদারিটি ১৯০৪ সালে ৩,২০,৯৬৪ টাকা খাজনা হিসেবে সরকারকে প্রদান করে সকল ব্যয় বাদ দিয়ে নীট আয় করে ৫,৮০,৮৫৭ টাকা।

গণি মিয়ার সময়কাল থেকেই খাজা পরিবারটি দেশের রাজনৈতিক  এবং সামাজিক কর্মকান্ডের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে। আবদুল গণি একজন অত্যন্ত দানশীল ব্যক্তি ছিলেন এবং রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি পর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে তিনি যে দান প্রদান করেন তা ছিল ব্যাপক এবং অত্যন্ত প্রশংসনীয়। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, ক্লাব, দাতব্য চিকিৎসালয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, সমাধি ও অসুস্থ গরিব মানুষের সাহায্যে গণি মিয়া বিপুল অর্থ ব্যয় করেন। তিনি নিজস্ব ব্যয়ে ঢাকা শহরের জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করেন এবং রাস্তায় গ্যাস বাতি সরবরাহ করেন। ১৮৭৪ সালের ৬ আগষ্ট তারিখে গভর্নর জেনারেল লর্ড নর্থ ব্রুক এ বিশুদ্ধ পানির কলের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ঢাকাবাসীকে পঞ্চায়েত মহল্লার অন্তর্ভুক্ত করে তিনি তাঁর নেতৃত্ব এবং সামাজিক দায় দায়িত্বের একটি বড় রকমের স্বাক্ষর রেখে যান।

১৮৫৭ সালে সিপাহি বিপ্লব এর সময় ব্রিটিস রাজ্যের প্রতি তাঁর সমর্থন জানিয়ে যে আনুগত্য প্রকাশ করেন তা ক্রমান্বয়ে চলতে থাকে, যার ফলে ঔপনিবেশিক আমলে শাসকদের কাছে তাঁর ভাবমূর্তি বিরাট আকার ধারণ করে। অনানুষ্ঠানিক শাসন ব্যবস্থা যা ঢাকার পঞ্চায়েত ব্যবস্থা নামে পরিচিত ছিল, তা গড়ে তুলতে তিনি প্রশাসকদের সাহয্য ও সহযোগিতা পেয়েছিলেন। ১৮৬৪ সালে গণি মিয়াকে ঢাকায় নবপ্রতিষ্ঠিত ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির একজন মনোনীত কমিশনার নির্বাচন করা হয়। তাঁর অসাধারণ নেতৃত্ব এবং বদান্যতার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে একজন অবৈতনিক (অনারারি) ম্যাজিস্ট্রেট, ১৮৬৬ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদের একজন সম্মানিত সদস্য, ১৮৬৭ সালে মাননীয় গভর্নর জেনারেলের আইন পরিষদের একজন অতিরিক্ত সদস্য নিয়োগ করা হয়। ১৮৭১ সালে তাঁকে সি.এস.আই করা হয়। ১৮৭৫ সালে তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে নওয়াব উপাধিতে ভূষিত করা হয়। উপাধিটি ১৮৭৭ সালে উত্তরাধিকারমূলক করা হয় এবং তা পুরুষানুক্রমে চলতে থাকে। ১৮৮৬  সালে নওয়াব আবদুল গণিকে কে.সি.এস.আই উপাধিতে ভূষিত করা হয়। পূর্ববাংলার প্রায় সকল শ্রেণীর মানুষের কাছেই তিনি একজন সম্মানিত, ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং ঢাকার গোষ্ঠিপতি হিসেবে পরিচিত ছেলেন। তিনি ১৮৯৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

মৃত্যুর বহুপূর্বেই গণি মিয়া তাঁর অত্যন্ত যোগ্যপুত্র খাজা আহসানুল্লাহকে জমিদারির মুতাওয়াল্লি অর্থাৎ গদিনশিন করেন। নওয়াব স্যার খাজা আহসানুল্লাহ অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে তাঁর পিতা এবং পিতামহের প্রশংসনীয় সকল কর্মকান্ড ও ঐতিহ্যই সুচারুরূপে বজায় রাখেন। অবশ্য তাঁর সময়কালে জামিদারির বিস্তৃতি বা হ্রাস কোনটিই হয় নি। আহসনুল্লাহ তাঁর জমিদারি বিস্তৃতির পরিবর্তে তাঁদের জমিদারির ভিত্তি শক্ত ও ব্যবস্থাপনাকে সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত করার পরিকল্পনার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন, কেননা তাঁর সময়েই দেশে জমিদারি প্রথার উপর Bengal Tenancy Act, 1885 হুমকি রূপে আবির্ভূত হয়। এ আইন প্রবর্তনের পর পরই দেশে দূরদর্শী জমিদাররা জমিতে বিদ্যমান মধ্যস্বত্ব ও রায়তিস্বত্ব ক্রয় করার একটা প্রবণতা প্রদর্শন করেন। এ কৌশল অবলম্বন করা হয় উদ্ভূত ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশে প্রজাদের উপর জমিদারদের সনাতনী নিয়ন্ত্রণ অটুট রাখার উদ্দেশ্যে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আহসানুল্লাহ পরিবারের বাড়তি সম্পদ দিয়ে বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য রায়তি এবং প্রজাস্বত্ব ক্রয় করেন এবং এগুলিকে খাস জমি হিসেবে ব্যবস্থা গ্রহন করেন। এ নতুন ব্যবস্থাপনায় খাজাগণ নিজেরাই তাদের এস্টেটের প্রজাতে রূপান্তরিত হন। এ দূরদর্শিতাপূর্ণ কাজের কারণেই যখন ১৯৫১ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয় তখন নওয়াব এস্টেট চরম বিপর্যয় থেকে রক্ষা পায়।

খাজা আহসানুল্লাহও ব্রিটিসরাজের একজন অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ ও শক্তিশালী সহযোগী ছিলেন এবং ঔপনিবেশিক সরকারও প্রতিদানে তাঁকে বিভিন্নভাবে কার্যকর সহযোগিতা প্রদান করেন। বহু বছর ধরে তিনি ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির একজন সম্মানিত কমিশনার ছিলেন, যদিও মিউনিসিপ্যালিটির সভা-সমিতিতে তিনি খুব একটা যেতেন না। তিনি তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিগত পদ্ধতিতে ঢাকা নগরটির উপর প্রভাব বিস্তার করতেন এবং প্রয়োজনে শহরটির মঙ্গলের জন্য নানা ধরণের ব্যবস্থাও গ্রহণ করতেন। বলা হয়ে থাকে যে, শহরটির উন্নয়নে তাঁর ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনা মিউনিসিপ্যালিটির পরিচালনার ধরণ থেকে অনেক বেশি কার্যকর ছিল। খাজা আহসানুল্লাহকেও ১৮৭৫ সালে নওয়াব, ১৮৯১ সালে একজন সি.আই.ই, ১৮৯২ সালে নওয়াব বাহাদুর, ১৮৯৭ সালে একজন কে.সি.আই.ই এবং ১৮৯০ ও ১৮৯৯ সালে গভর্নর জেনারেলের আইন পরিষদের একজন সম্মানিত সদস্য নিযুক্ত করা হয়। তিনি ১৯০১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে গভর্নর জেনারেল, বাংলার ছোটলাট এবং বাংলার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ গভীর শোক প্রকাশ করেন।

উনিশ শতককে যদি ঢাকা নওয়াব পরিবারের সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নতি এবং পারিবারিক সফলতার শতক হিসেবে চিহ্নিত করা যায় তাহলে একইভাবে বিশ শতককে তাদের ক্রমান্বয়ে পতন ও পরিবারটির বিলুপ্তির সাক্ষ্য হিসেবে ধরা যেতে পারে। ১৯০২ সালে আহসানুল্লাহর জ্যেষ্ঠপুত্র নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহ জমিদারির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু অচিরেই পারিবারিক কোন্দল শুরু হয় এবং সলিমুল্লাহ পরিবারটির উপর সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। জমিদারি ব্যবস্থাপনায় এত বেশি ফাটল ধরে যে, সরকারকে প্রদত্ত খাজনার বকেয়া এবং এস্টেটের দেনা ক্রমাগত ভাবে বাড়তেই থাকে। এ পর্যায়ে সরকার রাজনৈতিক বিবেচনার পরিপ্রেক্ষিতে নওয়াব সলিমুল্লাহকে অর্থ ও অন্যান্য সকল প্রকার সহযোগিতা ও সাহায্য প্রদান করেন। ব্রিটিস সরকারের এ সাহায্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল সলিমুল্লাহকে ১৯০৮ সালে একটি বড় অংকের ঋণ প্রদান করা, যে ঋণ দিয়ে তিনি হিন্দু মহাজনদের নিকট তাঁর ব্যক্তিগত সকল দেনা পরিশোধ করতে সক্ষম হন।

ঔপনিবেশিক সময়ে একটি সরকারি নীতি ছিল দেশীয় অনুগত ভুস্বামীদেরকে জিইয়ে রাখা। এর নেপথ্যে ছিল শাসক শ্রেণীর উপর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ক্রমাগত চাপ। এমনি এক পরিস্থিতিতে ভগ্নপ্রায় ও টলটলায়মান ঢাকা নওয়াব এস্টেটকে ১৯০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীনে নিয়ে আসা হয়। কোর্ট অব ওয়ার্ডসের তত্ত্বাবধানে এস্টেটটির প্রথম ব্যবস্থাপক ছিলেন এইচ. সি.এফ মেয়ার। তারপরে আসেন এল.জি পিলেন, পি.জে গ্রিফিথ এবং পি.ডি মার্টিন। এরা সবাই ছিলেন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের সদস্য। ১৯৫০ সালের ইস্ট বেঙ্গল এস্টেট একুইজিশন অ্যাক্ট এর অধীনে ১৯৫০ সালে ঢাকা নওয়াব এস্টেটের বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়। কেবল আহসান মঞ্জিল প্রাসাদ ও তৎসংলগ্ন জমিজমা এবং অন্যান্য স্থানে যে সকল জমি রায়তিস্বত্বে খাসজমি ছিল সেগুলি এ অধিগ্রহণ আইনের আওতার বাইরে থাকে। কিন্তু অনেকগুলি অসমাপ্ত পারিবারিক দাবি থাকার কারণে নওয়াব এস্টেটের বহু বিষয় সম্পত্তি এরপরও কোর্ট অব ওয়ার্ডস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। কোর্ট অব ওয়ার্ডসের উত্তরসূরি বাংলাদেশ ভূমি সংস্কার বোর্ড এখন এ ঐতিহ্যবাহী পরিবারের কিছু পরিমাণ সম্পত্তি দেখাশোনা করছে।

ঢাকা নওয়াব পরিবারের বংশ তালিকা

ঢাকা নবাব পরিবারের আদিপুরুষ কাশ্মির হতে আগত আব্দুল কাদেরের দুই পুত্র আব্দুল ওয়াহাব এবং আব্দুল্লাহ ঢাকা এসে বসবাস ও ব্যবসা শুরু করেন। আব্দুল ওয়াহাবের এক মাত্র পুত্র (খাদেমার গর্ভজাত) খলিলুল্লাহ উচছৃঙ্খল জীবন যাপন করে তার সম্পদ উড়িয়ে দেন। আব্দুল্লাহ এর চার পুত্র ও এক কন্যা যাথাক্রমে (১) আহসানুল্লাহ (২) হাফিজুল্লাহ (৩) আব্দুল আজিম (৪) আব্দুর রহমান এবং এক কন্যা নান্নী বিবি। জ্যেষ্ঠপুত্র আহসানুল্লাহ বিয়ে করেন আব্দুল হাকিমের পৌত্রী ফাতেমা খানমকে। আহসানুল্লাহর তিন পুত্র যথাক্রমে (১) আতিকুল্লাহ (২) সলিমুল্লাহ ও (৩) আলিমুল্লাহ। হাফিজুল্লাহর এক পুত্র আব্দুল গফুর। আলিমুল্লাহ মানুষ হয়েছিলেন চাচা হাফিজুল্লাহর নিকট। হাফিজুল্লাহই তাকে শিখিয়েছিলেন ব্যবসা বাণিজ্য এবং জমিদারি ক্রয়ের উপায়। মূলত: আলিমুল্লাহকে ঢাকা নবাব পরিবারের জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়ে থাকে। আলিমুল্লাহর নয় স্ত্রীর গর্ভে পঁনেরটি সন্তান জন্ম গ্রহণ করেন। নিম্নে নয় স্ত্রীর এবং তাদের সন্তানদের নামোল্লেখ করা হলো।

১।        স্ত্রী খয়ন নেসা বিবি;    সন্তান (১) আব্দুল হাকিম (২) ইসমাতুন নেসা (৩) শাহজাদী খানম।

২।        স্ত্রী জিনাত বিবি;                      সন্তান (৪) নবাব আব্দুল গণি (৫) বিলায়তী খানম (৬) বড়ী খানম।

৩।        স্ত্রী ঘাসী বিবি;              সন্তান (৭) আব্দুল হামিদ (৮) আব্দুন নবী (৯) উমদাতুননেসা।

৪।        স্ত্রী বি-জান বিবি;                     সন্তান (১০) আব্দুল লতিফ।

৫।        স্ত্রী আইয়ুব বিবি;                     সন্তান (১১) হুসনা খানম।

৬।        স্ত্রী নার্গিস বিবি;                      সন্তান (১২) হামিদুন খানম।

৭।        স্ত্রী বাসন্তী বিবি;                       সন্তান (১৩) মুজাফফর।

৮।        স্ত্রী আমিরজান বিবি;   সন্তান (১৪) মনসুর।

৯।        স্ত্রী ফুলকলি বিবি;                   সন্তান (১৫) ফুলোবিবি।

আব্দুল গণির সময়ে নবাব পরিবারের জমিদারির বিস্তৃতি ঘটে এবং পূর্ব বাঙলার সর্ববৃহৎ জমিদারিতে পরিণত হয়। ব্রিটিস সরকার ১৮৯২ সালের ১ জানুয়ারি আব্দুল গণিকে ’’নওয়াব বাহাদুর’’ খেতাব প্রদান করেন। নবাব আব্দুল গণির চার স্ত্রীর গর্ভে মোট দশটি সন্তান জন্ম গ্রহণ করেন। নিম্নে স্ত্রীদের নামের পাশে গর্ভজাত সন্তানদের নামোল্লেখ করা হলো।

১।        স্ত্রী ইসমাতুন নেসা (মৃত-১৮৮৭;       সন্তান  (১) আয়শা খানম (২) নবাব আহসানুল্লাহ

(৩)  আলিমুল্লাহ ওরফে সুলতান জান।

২।        স্ত্রী উমদা খানম;                                  সন্তান (৪) মুনিরা খানম (৫) সালেহা খানম

(৬) নূরজাহান খানম (৭) বাকি (৮) সাকি।

৩।        স্ত্রী মুন্নি বিবি;                           সন্তান (৯) কারিমুল্লাহ।

৪।        স্ত্রী দুলহান বিবি;                                 সন্তান (১০) আব্দুস সাত্তার নান্না মিয়া।

নবাব আহসানুল্লাহর তিন স্ত্রীর গর্ভে মোট পঁনেরটি সন্তান জন্ম গ্রহণ করেন। নিম্নে স্ত্রীগণের নামের পাশে গর্ভজাত সন্তানদের নামোল্লেখ করা হলো।

১।        স্ত্রী ওয়াহিদুনুনেসা ওরফে নওয়াব দুলহান; সন্তান (১) আব্দুল্লাহ (২) হাফিজুল্লাহ (৩) খাদিজা

(৪) আলিমুল্লাহ (৫) নওয়াব সলিমুল্লাহ

(৬) ফাতিমা খানম (বিলকিস বানু)

(৭) কুলসুম খানম (বাদশা বানু)

(৮) আমিনা বানু।

২।        স্ত্রী ফরহাত জান (নওয়াব বেগম);                 সন্তান (৯) আব্দুল গফুর (১০) আতিকুল্লাহ

(১১) কলিমুল্লাহ (১২) পুত্র (নাম অজ্ঞাত)।

৩।        স্ত্রী কামরুন বিবি;                                            সন্তান (১৩) পরী বানু (১৪) মেহের বানু

(১৫) আখতার বানু।

নবাব স্যার সলিমুল্লাহ মৃত্যুকালে চার স্ত্রী, পাঁচ পুত্র ও তিন কন্যা রেখে যান। তাঁর সাতটি পুত্র জন্ম গ্রহণের তথ্য পাওয়া যায়।

১।        পুত্রগণের নাম (১) নবাব হাবিবুল্লাহ (২) আলিমুল্লাহ (৩) আব্দুল গণি (মৃত) (৪) হাফিজুল্লাহ (৫) নসরুল্লাহ (৬) গোলামুসসাকলাইন (মৃত) (৭) আহসানুল্লাহ।

২।        কন্যাগণের নাম (১) ফরহাত বানু (২) আফতাব বানু (৩) খুরশিদ বানু (৪) আহমদী বানু।

নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ১৯০৮ সালের ৬ আগস্ট ৪১৪২নং ইনডেনচার সম্পাদনের মাধ্যমে ঢাকা নবাব এস্টেট কোর্ট অব ওয়ার্ডসের নিকট অর্পণ করেন। সেহেতু নবাব পরিবারের বংশ তালিকা তাঁর সময় পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে।